চলতি বছর ঈদুল ফিতরের ‘চাঁদ দেখা না দেখা’ নিয়ে বিভ্রান্তি হওয়ায় চাঁদ দেখার অ্যানালগ যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। যদিও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (স্পারসো) ও আবহাওয়া অধিদফতরে এ ধরনের ৫২টি যন্ত্র আগে থেকেই রয়েছে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠান চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যও। দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫২টি যন্ত্র থাকার পরও আরেকটি যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, আবহাওয়া অধিদফতর অপটিক্যাল থিওডোলাইট নামের চাঁদ দেখার একেকটি যন্ত্র কিনেছিল ২৫ লাখ টাকায়। এখন অ্যানালগ সিস্টেমে পরিচালিত একই ধরনের অপটিক্যাল থিওডোলাইট যন্ত্র কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এরই মধ্যে এই যন্ত্র কিনতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ৪ জুন ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পর ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চাঁদ দেখার যন্ত্র থিওডোলাইট কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই যন্ত্র কেনার পরামর্শ দেয়। সেই অনুযায়ী টেন্ডার আহ্বান করা হয়। চাঁদ দেখা যন্ত্র কেনার আহ্বায়ক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। আশা করছি, এ মাসের মধ্যেই যন্ত্রটি কেনা হয়ে যাবে।’ কোন দেশ থেকে যন্ত্রটি কিনছেন এবং এটি অপটিক্যাল নাকি মাইক্রোওয়েভ, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘যন্ত্রটি আমেরিকা থেকে কেনা হচ্ছে। এর দাম পড়বে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। আর অপটিক্যাল নাকি মাইক্রোওয়েভ তা বলতে পারছি না। আবহাওয়া অধিদফতর যে পরামর্শ দিয়েছে তাই কেনা হচ্ছে।’
তবে এটি দিয়ে হালকা মেঘেও চাঁদ দেখা যাবে। আকাশে বেশি মেঘ থাকলে এই যন্ত্র দিয়ে চাঁদ দেখা সম্ভব হবে না বলে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়ে বলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাসচিব। কোথায় চাঁদ দেখা যন্ত্রটি বসানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি যন্ত্রটি কোথায় বসানো হবে? তবে যেখানে পশ্চিম আকাশ ভালোভাবে দেখা যাবে সেখানেই বসানো হবে। সেই হিসেবে আপাতত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আগারগাঁও ভবনের ছাদে বসানো হতে পারে।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ লাখ টাকা খরচ করে চাঁদ দেখার জন্য যে যন্ত্রটি কেনা হচ্ছে, সেটি মূলত একটি অপটিক্যাল থিওডোলাইট। যা দিয়ে আকাশে মেঘ থাকলে চাঁদ দেখা সম্ভব হবে না। এ ধরনের অপটিক্যাল থিওডোলাইট যন্ত্র আবহাওয়া অধিদফতরের হেড অফিসে ৮টি এবং ৪৩ জেলা আবহাওয়া অফিসে রয়েছে ৪৩টি যন্ত্র। একই ধরনের একটি যন্ত্র মহাকাশ গবেষণা কেন্ত্রের রয়েছে। এই সংস্থাটি আরও পাঁচটি টেলিস্কোপ বসানোর চিন্তা করছে।
একই যন্ত্র চাঁদ দেখা কমিটিতে থাকা দুই সদস্য প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। এরপরও আলাদা করে কেনার দরকার কী জানতে চাইলে সচিব কাজী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের থাকলেও আমাদের নেই, তাই এ ধরনের যন্ত্র কিনতে হচ্ছে। আগের যে যন্ত্র রয়েছে তার চেয়েও এটি উন্নত ও আধুনিকমানের। আপাতত একটা কেনা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্য জেলাগুলোতেও এই যন্ত্র বসানো হবে।’ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মিজানুর রহমান (চাঁদ দেখা কমিটির সদস্য) বলেন, ‘এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয় বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের কাছে থেকে কোনো পরামর্শ নেয়নি। যে যন্ত্রটি কেনা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি, তা মূলত অ্যানালগ এবং অপটিক্যাল। যা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ও আবহাওয়া অধিদফতরের রয়েছে। আকাশে মেঘ থাকলে এই যন্ত্র দিয়ে চাঁদ দেখা সম্ভব হয় না। এরপরেও একই ধরনের যন্ত্র ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিনছে। কার পরামর্শে কেনা হচ্ছে জানা নেই বলেও জানান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব প্রায় ২ লাখ ৩৮ হাজার মাইল। অপটিক্যাল যন্ত্র দিয়ে চাঁদ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে মাত্র এক ভাগ। আর যদি মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র কেনা হয় তাহলে এর সম্ভাবনা থাকে ৯৫ ভাগ। কারণ মাইক্রোওয়েভ সিস্টেমে আকাশে অনেক বেশি মেঘ থাকলেও তা ভেদ করে সিগনাল নিয়ে আসে এবং চাঁদ দেখা সম্ভব হয়।’ আকাশে মেঘ থাকলে চাঁদ দেখা সম্ভব হবে না তাহলে কেন এমন যন্ত্র কিনছেন, জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক আনিসুর রহমান (চাঁদ দেখা যন্ত্র ক্রয় কমিটির সদস্য) বলেন, ‘আবহাওয়া অধিদফতর যে পরামর্শ দিয়েছেন সেই অনুযায়ী যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদফতরের উপ পরিচালক আজিজুর রহমানের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।’
আবহাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘থিওডোলাইট কেনার ব্যাপারে আমি তেমন কিছু জানি না। চাঁদ দেখা কমিটির সদস্য হওয়ায় পরামর্শ পেপারে আমাকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে।’ কী ধরনের যন্ত্র, কোন দেশের যন্ত্র কী কাজ করবে এর সবই প্রজেক্ট আকারে লিখেছেন আবহাওয়া অধিদফতরের প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক তরফদার। তার কাছে গেলে এসব বিষয় জানতে পারবেন বলে জানান আজিজুর রহমান। এ বিষয়ে জানতে আবহাওয়া অধিদফতরের প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক তরফদারের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে বলা হলো যে, চাঁদ দেখার জন্য আবহাওয়া অধিদফরের আদলে একটি যন্ত্র কিনতে চান। তাই একটি পেপার তৈরি করে দেওয়ার জন্য আমাকে বলা হয়। আমি সেই অনুযায়ী কোটেশন দিয়ে একটু পেপার প্রস্তুত করে আজিজুর রহমানকে দিয়ে স্বাক্ষর করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জমা দেই। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অধিদফতরের যে থিওডোলাইট রয়েছে সেগুলোর দাম মূলত ২৫ লাখ টাকা। কিছু যন্ত্রের দাম ২৫ লাখের বেশি আবার কিছু যন্ত্রের কম। এখন আধুনিক যুগ, যন্ত্রের তারতম্য হয়েছে আবার সময়ের ব্যবধানে টাকাও বেড়েছে এ জন্য হয়ত মন্ত্রণালয় যন্ত্রটি কেনার খরচ ৫০ লাখ টাকা ধরেছে।’ আপনি কেন মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র কেনার পরামর্শ দেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনারা যে যন্ত্রের জন্য পেপার রেডি করতে বলেছেন আমি তাই দিয়েছি।’ নতুন থিওডোলাইট যন্ত্রটি কে পরিচালনা করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কোম্পানির মাধ্যমে যন্ত্রটি কেনা হবে তারা হয়ত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে। আর যখন চাঁদ দেখার জন্য লাগবে তখন হয়ত আমাদের কোনো কর্মকর্তা গিয়ে চাঁদ দেখার বিষয়টি বুঝিয়ে দেবেন। এ ছাড়া ওনাদের কেউ তো এ কাজে পারদর্শী নন। তাছাড়া আরও বেশি কিছু জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক আনিসুর রহমানের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
থিওডোলাইট যন্ত্র বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইসলামি ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিনের কাছে গেলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবহাওয়া অধিদফতরের পরামর্শে চাঁদ দেখা যন্ত্র কেনার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।’ যন্ত্র কেনার বিষয়ে এর বেশি তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান তিনি। আধুনিক যুগে এসে সেই পুরনো অ্যানালগ সিস্টেমের চাঁদ দেখার জন্য যন্ত্র কেন কেনা হচ্ছে জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা বিশেষজ্ঞ তাদের পরামর্শেই চাঁদ দেখা যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চাঁদ দেখার জন্য তো একটা যন্ত্র আমাদের তো থাকল। ভবিষ্যতে আরও আধুনিক যন্ত্র কেনার ব্যাপারে ভাবা হবে।’
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।