২০০৯ সালে বিদ্রোহের নামে পিলখানা সদর দফতরে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও দশ বছরে শেষ হয়নি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার কাজ। বিস্ফোরক আইনের মামলায় এক হাজার ২৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে দশ বছরে নেয়া হয়েছে মাত্র ৭৮ জনের সাক্ষ্য। দুই মামলার আসামি হওয়ায় হত্যা মামলায় খালাস পেয়েও মুক্তি পাননি ২৪৬ জন। সাক্ষ্যগ্রহণের অভাবে মূলত মামলাটি ঝুলে আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের এদিনে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবির সদর দফতর) দরবার হলসহ আশপাশের এলাকা। পিলখানা ছাপিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সারাদেশে। বিডিআর সদর দফতর পিলখানায় বিদ্রোহের নামে চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। দরবার চলাকালে দরবার হলেই তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যা করেন উদ্ধত জওয়ানরা। বেছে বেছে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। যার মধ্যে হত্যা মামলায় আসামি করা হয় ৮৫০ জনকে। আর বিস্ফোরক মামলায় আসামি সংখ্যা ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, বাকিরা বিডিআরের জওয়ান। এ মামলায় অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। এতে খালাস পান ২৭৭ জন। পরে ২০১৭ সালে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়া ১৩ জনের মধ্যে আটজন যাবজ্জীবন, চারজন খালাস পান।
বিস্ফোরক আইনের মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে। কিন্তু গত ১০ বছরে ওই মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়নি। এক হাজার ২৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৭৮ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হয়েছে। হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে এখনও কারাগারে আছেন ২৪৬ জন। আবার হত্যা মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ নথি প্রকাশ না হওয়ায় এসব রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছেন না আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ অবস্থায় ঠিক কবে নাগাদ বিচার শেষ হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্ফোরক মামলার আসামি ৮৩৪ জন। মামলাটি হত্যা মামলার সঙ্গে বিচার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝ পথে শুধু হত্যা মামলার সক্ষ্য উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করেনি। একপর্যায়ে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত করে দেয় রাষ্ট্রপক্ষ।’ তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলার একতরফা সাক্ষ্যগ্রহণ করে ২০১৩ সালে বিচার শেষ হয়। এরপর আমরা আপিল করি। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর আপিলের রায়ও হয়ে যায়। এরপর তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে তারা এক হাজার ২৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৭৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পেরেছেন।’
‘এ মামলার অনেক আসামি কারাগারে থাকতেই মারা গেছেন’ জানিয়ে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাকি সব আসামি এখন কারাগারে আছেন। হত্যা মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ না পাওয়ায় যাদের সাজা বহাল আছে তাদের জন্য আপিল আমরা করতে পারছি না। আবার যারা খালাস পেয়েছেন তারাও বের হতে পারছে না বিস্ফোরক মামলার কারণে। আবার স্বল্পমেয়াদে যাদের সাজা হয়েছে, ইতোমধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে; তারাও বের হতে পারেননি হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ কপি বের না হওয়ার কারণে।’
বিস্ফোরক মামলার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, ‘বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১২ শতাধিক সাক্ষী। সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।’ তবে দ্রুতই এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ আইনজীবী। এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম বলেন, ‘ধীরগতির কিছু নেই, বিচার কাজ তার নিজস্ব গতিতেই চলছে।’ হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় কবে প্রকাশ হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসামির সংখ্যা ও সাক্ষীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে খানিকটা সময় লাগতে পারে।’ আগামী ৪ মার্চ মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েসের আদালতে বিস্ফোরক মামলার ৭৫তম কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।