সরাইল উপজেলার তিতাস নদীর বুকে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ কেবল একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, বরং এটি সরাইলবাসীর জীবন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। সোমবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে সরাইলের তিতাস নদীতে নৌকা বাইচ দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের এক অনন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। শাহজাদপুর ইউনিয়নের মলাইশ সংলগ্ন নদীর দুই তীরে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামীণ জনতা, শহরের মানুষ, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা—সকলেই নদীর দুই তীরে জড়ো হয় নৌকা বাইচ উপভোগ করতে।
নৌকা বাইচের সময় দাঁড়িদের ছন্দময় বৈঠা, দর্শকের উল্লাস ও ঢাক-ঢোলের তালে তালে তিতাস নদী যেন জীবন্ত জনসমুদ্র হয়ে ওঠে। প্রতিযোগিতার নৌকাগুলো নদীর বুকে সাজ সাজ রূপে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িদের একরঙা পোশাক, গলায় সুর তোলা গান এবং দর্শকের উত্তেজনা মিলেমিশে সৃষ্টি করে এক অপূর্ব আবহ। নৌকা যখন গতি পায়, তখন দর্শকের কণ্ঠে একসঙ্গে ধ্বনি ওঠে, যা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেয়।
নৌকা বাইচের ইতিহাস সমৃদ্ধ। ত্রিপুরা জেলা গেজেটীয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৮ সালে তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ ছিল এক ঐতিহাসিক আয়োজন। সে সময় আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরা ও কুটির ইংরেজ পাট ব্যবসায়ীরা বিপুল সোনার মেডেল দিয়ে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করতেন। ত্রিশের দশকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সংলগ্ন তিতাস নদীতে জাঁকজমকপূর্ণ গণ-উৎসবের মাধ্যমে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো। বিজয়ী নৌকাকে দেওয়া হতো মেডেল, কাপ, শিল্ড, পিতলের কলস বা একটি পাঁঠা পর্যন্ত। নদীর বুকে লঞ্চ, ছোট নৌকা, কোষা, কলাগাছের ভেলা, মাটির গামলা—সবই সাজানো হতো রঙিন কাগজের ফুল দিয়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আনন্দে মেতে উঠত।
আজকের নৌকা বাইচ সেই ঐতিহ্যকে ধারাবাহিকভাবে বহন করছে। মানুষের উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু প্রতিযোগিতা দেখছে না, বরং নিজেদের সংস্কৃতিকে স্পর্শ করছে। সরাইলের নৌকা বাইচ এখন একটি সমন্বিত লোকোৎসব, যা নদীর জলে এবং মানুষের হৃদয়ে ঢেউ তোলে।
নৌকা বাইচের মাধ্যমে সরাইলের মানুষ কেবল তাদের প্রতিযোগিতামূলক দিকই প্রদর্শন করছে না, বরং প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ বজায় রাখছে। এটি প্রমাণ করে যে, নৌকা বাইচ শুধুমাত্র ক্রীড়া নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সত্যিই, তিতাসের নৌকা বাইচ মানুষের হৃদয়ে ঢেউ তোলে, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে আসছে।