বরিশালে ফণী’র প্রভাবে পানিতে ভাসছে কৃষকের স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ৬ই মে ২০১৯ ০৫:০৬ অপরাহ্ন
বরিশালে ফণী’র প্রভাবে পানিতে ভাসছে কৃষকের স্বপ্ন

দক্ষিণা লের কৃষকরা স্বপ্ন দেখেন বৈশাখ মাসে কর্ষ্টাজিত ফসল গোলায় তুলবে। আর সেই ফসল বিক্রি করে বছরের খরচের অর্থ যোগাবেন। কিন্তু ঘূর্নিঝড় ফণীর প্রভাবে দখিণের পটুয়াখালী, কলাপাড়া, মঠবাড়িয়া, গৌরনদী, ঝালকাঠির রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলায় নদী তীরের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে নদীর পানি ঢুকে পড়ায় ৯ হাজার হেক্টর ফস‌লি জ‌মি ক্ষ‌তিগ্রস্ত হ‌য়ে‌ছে ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। এর ম‌ধ্যে ৩ হাজার ৬৮০ হেক্টর বোরো ধান, ১ হাজার ৫১০ হেক্টর মুগডাল, ১ হাজার ৪৬৬ হেক্টর মরিচ, ২৫০ হেক্টর তিল, ৯৪০ হেক্টর শাকসবচি, ১২০ হেক্টর ভুট্টা, ৫৩৫ হেক্টর পান ও ৫৫২ হেক্টর সয়াবিন ক্ষেতের ক্ষতিসাধন হয়েছে। পাশাপাশি সাতলা বাগধা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের শিবপুর পয়েন্টে ২০ মিটার এবং বরিশাল নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তরগত নদী ভাঙ্গন রোধ কল্পে নির্মিত বাধে সামান্য ক্ষতির সৃষ্টি হলে তা তাৎক্ষনিকভাবে মেরামত করা হয়েছে ব‌লে জানান জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান। 

ঝালকাঠীতে পাঁচশ হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝালকাঠি জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ জানায়, বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন নদী তীরের বাসিন্দারা। কাঁঠালিয়ার শৌলজালিয়া গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, বিষখালী নদী তীরের বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে আমাদের বোরো ধানের ফসল তলিয়ে গেছে। পানি নামছে না, এতে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজাপুরের বড়াইয়া গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, ধানের জমি পানিতে ডুবে আছে। এই বছর ৫০ হাজার টাকার ফসলের ক্ষতি হতে পারে। পানির মধ্য থেকে অপরিপক্ক ধান কাটাও যাচ্ছে না। ঝালকাঠির ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন মাতুব্বর জানান, বোরোসহ ৪’শ হেক্টর জমির ফসল, ২৪টি কাচা ঘরবাড়ি ও ৪০০ ফুট বেড়িবাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করছি। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করে সর্বাত্মক সহযোগীতার দেয়া হয়ে বলে জানান তিনি। 

ঘূর্নিঝড় ফণীর প্রভাবে শুক্রবার বিকেল থেকে আড়িয়াল খাঁ ও পালরদী নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আড়িয়াল খাঁর গর্ভে ওই এলাকার অসংখ্য ফসলী জমি বিলীন হয়ে গেছে। গৌরনদীর মীরারচর ল ঘাটের অংশে ভাঙন দেখা দেয়ায় টার্মিনালটি নদীর মধ্যে চলে গেছে। নদীর তীরবর্তী কয়েকশ’ পরিবার ও শত শত একর ফসলী জমি ভাঙনের মুখে পরেছে। নদী ভাঙনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদা নাছরিন। তিনি বলেন, ফণীর প্রভাবে উত্তাল আড়িয়াল খাঁ ও পালরদী নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘুন্নয়নের সৃষ্টি হওয়ায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে করে গত দুইদিনে মিয়ারচর এলাকার অসংখ্য ফসলী জমি বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া নদীর তীরবর্তী কয়েকটি বসত বাড়ির আশিংক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অব্যাহত নদী ভাঙনে চরম হুমকির রয়েছে ওই এলাকার শত শত একর ফসলি জমি। ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবলে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় শতাধিক বসত ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের  ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির রবিশস্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং  উপড়ে পড়েছে পাঁচ শতাধিক গাছপালা। 

শনিবার দুপুরে জোয়ারের তোড়ে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, গরুভাঙা ও চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা গ্রাম প্লাবিত হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই ঝড়ে উপজেলার রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া, চরমোন্তাজ, বড়বাইশদিয়া ও চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নে ১৫৫০ হেক্টর মুগডাল, ২৫০ হেক্টর মরিচ, ৫ হেক্টর তিল, ২০ হেক্টর খরিপ-১ শাক-সবজি ও  ২৬০ হেক্টর বাদাম নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মামুন হোসেন বলেন, ‘ফণীর প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে  চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, গরুভাঙা ও চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা এলাকার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে কৃষি জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় ফসল উৎপাদনে স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেই ক্ষতি যাতে না হয়, এজন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হবে। 

পটুয়াখালীর আট উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা প্রশাসন। সংবাদ সম্মেলনে ফণীতে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী। মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পটুয়াখালীর আট উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ১১ জন আহত হয়েছেন। ৬০১৮ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০৯২টি ঘরবাড়ি ও ১৭৫টি গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। ৩১২৫টি গাছপালা ভেঙে গেছে। ৫০টি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জেলায় বর্তমানে ২০০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ পাঁচ লাখ টাকা মজুত আছে। পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, মির্জাগঞ্জে ০.৫০০ কিলোমিটার, দুমকিতে ০.৫০০ কিলোমিটার, গলাচিপায় ৩ কিলোমিটার, রাঙ্গাবালীতে ৩ কিলোমিটার ও কলাপাড়ায় ৩ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বমোট ১০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় শেষে ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সে অনুযায়ী ভাঙা বাঁধগুলো মেরামত করা হবে। 

পিরোজপুরে ঘূর্ণিঝড় ফণি’র প্রভাবে গাছপালা ভেঙ্গে পড়াসহ নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কিছু এলাকায় পানি ঢুকে নি¤œ ল প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার শাপলেজা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বড় মাছুয়া ষ্টিমার ঘাট বেড়িবাঁধ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দমকা হাওয়ায় কলাগাছ ও পেপে বাগানসহ কৃষিতে ৫০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা কৃষি অফিস নিশ্চিত করেছে। মঠবাড়িয়া উপজেলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জি.এম সরফরাজ জানান, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৭৯১টি পরিবার ও ৪ হাজার ৭৩২জন লোক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে ২৩০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ ও ৫৭২ একর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঝড়ে ২৪৫টি কাঁচা ঘর ও ৪৩৭টি আংশিক কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্থহয়েছে।

এছাড়া উপজেলার ২.৬ কিলোমিটার বেড়ি বাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড পিরোজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাঈদ আহম্মেদ জানান, মঠবাড়িয়া উপজেলার শাপলেজা ইউনিয়নের দুইটি পয়েন্ট থেকে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে খেতাচিড়া ও কচুবাড়িয়া এবং চরভোলমারা, ভাইজোড়া, নিজামিয়া প্রভৃতি গ্রামের নিচু এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। শাপলেজা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন জানান, শনিবার দুপুরে খেতাচিড়া ও কচুবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, শুক্রবার দুপুরে মঠবাড়িয়ার খেতাচিড়া গ্রামে শতাধিক কাঁচাঘর বির্ধ্বস্ত হয়েছে। জেলার ইন্দুরকানীতে ফণি’র প্রভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ৮ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শতাধিক কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ইন্দুরকানী গ্রামের কলা চাষী আনোয়ার হোসেন জানান, তার তিন শতাধিক কলাগাছ ভেঙ্গে যাওয়ায় বেশ ক্ষতি হয়েছে। বরিশালের জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান বলেন, ‘সতর্ক বার্তা পেয়ে আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। আল্লাহ রহমত করেছেন বলেই বরিশালে কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

ইনিউজ ৭১/এম.আর