বিমান ছিনতাইয়ের বর্ণনা দিলেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে , আমরা হুবহু তুলে ধরলাম আপনাদের কাছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মশিউর রহমান যিনি গত ২৪ শে ফেব্রুয়ারি (রোববার) বিমান ছিনতাই নাটকের প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে ফেসবুকে তার একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা করেন।মশিউর রহমান বর্তমানে দুবাই রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া প্রকৃত বিষয়টি বর্ণনা করেন।২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বয়স ৬৫ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একজন পেশাদার ব্যাংকার হিসেবে আমার ক্যারিয়ারকে বিদায় জানানোর সময় এটা।পেশাগত জীবনে ভালো কাজ করার জন্য বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও সহকর্মীরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তারা আমাকে বিশ্রাম ও অবসরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন। তবে অবসরে যাওয়ার প্রথম দিনটি আমার পুরো জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলোর অন্যতম হয়ে থাকবে। তা কখনো বুঝতেই পারিনি।আমি ও লিলি অবসর নেয়ার পর পরই দুবাইয়ে বসবাসরত তার বোনদের কাছে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম ।এক সময়ে আমি অনেকদিন দুবাইয়ে বসবাস করেছি যখন সেখানে কাজ করেছিলাম।এর ফলে প্রিয়জনদের সঙ্গে আমাকে নতুন করে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে।
তাই ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে আমরা বিজি ১৪৭ চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী বিমানে আরোহণ করি। আমরা আন্তর্জাতিক যাত্রায় এক দশকে জাতীয় বিমান ব্যবহার করিনি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিমানের উন্নতির কথা শুনেছি। তাই আমরা বিজনেস ক্লাসে চড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।লিলি এবং আমি বিমানের জানালার পাশে দুই নাম্বার সারিতে বসলাম। এটি বিমানের বাম পাশের সামনের সারির পরের সারি।আমাদের ডানদিকে সামনের সারিতে বসেছিলেন প্রবীণ একজন নারী। তাঁর সঙ্গে ভদ্রলোক। সম্ভবত তারা দুজনই ভারতীয়। বিমানটি ঢাকা ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই এক ভদ্রলোক বিমানের বাম দিকের আসন থেকে উঠলেন কেবিন ক্রুদের অনুমতি নিয়ে। এতে আমার সামনের একটি আসনটি ফাঁকা হয়ে গেল।৫০ মিনিটের এই ফ্লাইটের প্রথম ১৫/২০ মিনিট বা ওই রকম সময় তেমন উল্লেখ করার মতো ছিল না। হঠাৎ আকস্মিকভাবে ইকোনমি ক্লাস থেকে একজন তরুণ উঠে এসে বিজনেস ক্লাসে প্রবেশ করলেন।
তিনি আমার সামনের ফাঁকা আসনে বসে গেলেন। তার সঙ্গে ছিল একটি ব্যাকপ্যাক। এতে কেবিন ক্রু অবাক হলেন। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ জানানোর আগেই তিনি তার ব্যাকপ্যাক খুলে ফেললেন। তার ভেতর হাত দিয়ে বের করলেন একটি অস্ত্র, একটি লাইটার ও বিস্ফোরকের মতো দেখতে একটি ডিভাইস। এক পর্যায়ে তিনি দাঁড়িয়ে বন্ধ ককপিটের খুব কাছে সামনের সারির গ্যালারিতে চলে গেলেন। এবং ইংরেজিতে বললেন- ‘এই বিমানটি ছিনতাই করা হয়েছে! অবিলম্বে ককপিটের দরজা খুলুন। যদি বিমানটি অবতরণ করে তাহলে আমি এটা উড়িয়ে দেবো’। এ শব্দগুলো কেবিনের সামনে সন্ত্রাসের আবহ ছড়িয়ে দিল। তখনও পর্দা নামানো (পরে তা খুলে দেয়া হয়)। ফলে পিছনের দিকে যারা বসা ছিলেন তারা বুঝতে পারেননি সামনে কী ঘটছে।
তখন আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি, ছিনতাইকারী সশস্ত্র অবস্থায়। যে নিজেকে প্রমাণ করতে সামনের একটি ফাঁকা শৌচাগারের দরজায় একবার তার হ্যান্ডগান দিয়ে গুলি করলো। কেবিনের বাতাসে বারুদের গন্ধ।যুবকটি চিৎকার করে বলতে লাগলো- ‘আমি একজন স্কটিশ নাগরিক। আমার মাত্র একটিই দাবি। তাহলো, আমি আমার স্ত্রীকে ফিরে পেতে চাই। সে একজন সেলিব্রেটি...’।যুবকটির আচরণ ছিল অস্বাভাবিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো মারাত্মকভাবে ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন অথবা মাদকের কারণে এমন করছেন।বিমানের সামনের সারির একেবারে কাছে বসার কারণে এই ঘটতে যাওয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমি খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই ফ্লাইটে তার স্ত্রী আছেন কিনা। জবাবে তিনি বললেন, ‘না। তিনি এই বিমানে নেই’।এক পর্যায়ে ওই যুবক উত্তেজিত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তিনি ককপিটের দরজায় লাথি মারতে শুরু করলেন। ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার দাবি তুললেন। কিন্তু ককপিটের ভেতর থেকে এর জবাবে কোনো শব্দ এলো না। অথচ এমন উচ্চস্বরে ওই যুবকটি চিৎকার করছিল যে, পাইলট তার চিৎকার পরিষ্কার শুনতে পারার কথা।
এবার বিমানটি দ্রুত নিচে নামতে শুরু করলো। বিমান উদ্বেগজনক গতিতে ৩০ হাজার ফুট উপর থেকে মাটির দিকে যেন মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মতো নেমে আসতে লাগলো। নিচে নামার এই পথে বিমানটি ভয়ঙ্করভাবে এপাশ ওপাশ দুলতে লাগলো।এ সময় পাইলটের একটিই লক্ষ্য ছিল। তা হলো, ককপিট ভেঙে ফেলার আগেই তিনি বিমানটিকে চট্টগ্রামে অবতরণ করাতে চান।তিনি জানতেন, তার হাতে প্রায় ১৫০ জন মানুষের প্রাণ।তাই তিনি ওই উন্মাদ ব্যক্তির হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ নিতে যা পারেন তার সবই করেছেন। তার এমন উদ্দেশ্য ছিল ওই ব্যক্তিকে ভারসাম্যহীন করে দেয়া। উত্তেজনার বশে ওই যুবক আবারো তার হাতের অস্ত্র থেকে ফাঁকা গুলি করলেন। এ সময় একজন ক্রু তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বিপজ্জনকভাবে কী ঘটাতে যাচ্ছেন ওই যুবক তা অনিশ্চিত। ফলে তিনি পেছনে ইকোনমিক কেবিনের দিকে ছুটে গেলেন।পিছনের দিকের যাত্রীরা যখন পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারলেন তখন শুরু হলো চিৎকার, চেচামেচি।
আমি ওই উত্তেজিত হয়ে ওই যুবকের কাছে চিৎকার করে জানতে চাইলাম- ‘আমাদের সবাইকে হত্যা করে কি ভাল কাজ করবেন? আমাদেরকে অবতরণ করতে দিন, যাতে আমাদের ১৫০ জনের সবাই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাতে পারি যেন, আপনি যা চান তা পূরণ করা হয়’।তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। বললেন, যদি বিমানটি অবতরণ করে তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি তা ঘটতে দেবেন না। তিনি বোমা দিয়ে বিমানটি উড়িয়ে দেবেন। তার এক হাতে বিস্ফোরকের ফিউজ ধরা। তার কাছে আরেক হাতে একটি লাইটার নিয়ে দুলাতে লাগলেন এবং আমাদেরকে হুমকি দিতে লাগলেন যে, আমাদের সবাইকে উড়িয়ে দেবেন। বলতে লাগলেন ‘আমি জানি বিমানটি যখন অবতরণ করবে তখন আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে’।
এ সময়ই প্রথম আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বিমানের অন্য স্থানগুলোতেও তার সহযোগী থাকতে পারে। কিন্তু তার কথা শুনে এবং তার চলাফেরা দেখে আমার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তিনি খুব সম্ভবত একা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মতো দক্ষতা অথবা মানসিক অবস্থা তার নেই। কিন্তু তার কাছে যে বিস্ফোরক ও অস্ত্র তা ভয়ঙ্কর রকম অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি করতে পারে।তড়িঘড়ি করে অবতরণ করার সময় আমি জানালা দিয়ে বঙ্গোপসাগর দেখতে পাই। সাগরের ওপরেই বিমান চট্টগ্রামমুখী হতে শুরু করে। আমরা কি অবতরণ করার মতো পর্যাপ্ত উচ্চতায় আছি, নাকি পাইলট বিমানটিকে পানিতে অবতরণ করাতে চাচ্ছেন তা আমি নিশ্চিত ছিলাম না।অবশেষে বিমান রানওয়েতে অবতরণ করলো। আমরা যে গতিতে টারমাকে আছড়ে পড়েছি তাতে বিমানের ক্ষয়ক্ষতি বা রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু পাইলট খুব দ্রুত আমাদের গতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হন।
আমার নিজের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। আমি ছিলাম ওই তরুণের কাছাকাছি, একেবারে সামনের সারিতে। যদি সে কাউকে গুলি করতো, তাহলে সেটা শুরু হতো কেবিন ক্রু বা আমি ও আমার স্ত্রীকে দিয়ে। আর যদি সে বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটাতো, সবচেয়ে বেশি আঘাত পেতাম আমি। আমাকে সেখান থেকে বের হয়ে বিমানের পেছনের দিকে তুলনামূলক নিরাপদ জায়গায় সরে পড়তে হয়।এমন পরিস্থিতিতে বিমানের কেবিন ক্রুদের সঙ্গে ওই তরুণের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। আমি লিলিকে বাহুতে জড়িয়ে রাখি। আমরা বাহু ও হাঁটুর ওপর ক্রলিং করে নিজেদের সিট থেকে মধ্যবর্তী করিডোরে বের হয়ে আসি। এবং বিমানের পেছনের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। বিজনেস কেবিনের অন্য যাত্রীরাও আমাদের অনুসরণ করেন।যখন আমরা পেছনে পৌঁছাই, ততক্ষণে একটি ইমার্জেন্সি এক্সিট (জরুরিভাবে বের হওয়ার দরজা) খোলা হয়েছে। সেটির সামনে মানুষের জটলা। এর বিপরীত পাশে যে ইমার্জেন্সি এক্সিটটি রয়েছে সেটি তখনো খোলা হয়নি। তাই সেটি খোলার চেষ্টা করি।
এর আগে বিমানের এক্সিট দরজা খোলার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিভাবে আমি সেটা খুলেছি তাও বলতে পারবো না। তবে আমি দরজাটি খুলেছি এবং বিমানের পাখার ওপর বের হয়ে এসেছি।পাখা থেকে টারমাক কতটুকু নিচে তখন আমি বুঝে উঠতে পারিনি। অবশ্যই এটা ১২ ফুট বা এর আশেপাশে হবে। আর কোন বিকল্প না থাকায়, আমি টারমাকে লাফিয়ে পড়ি।অনুভব করছিলাম যে, আমি পড়ছিই। আমার পতনটা খুব মসৃণ হয়নি। পরে বুঝতে পারি যে, আমার গোড়ালি বাজেভাবে ছিলে গেছে এবং হাঁটু মুচড়ে গেছে।কিন্তু যখনই চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছি, আমি লিলিকে নামতে সাহায্য করার কথা ভেবেছি। আমি ওপরে তাকিয়ে তাকে পাখার কিনারায় বসে কান্না করতে দেখি। আমি উঁচু হই, কিন্তু পাখায় ঝুলে থাকা তার পায়ের নাগাল পাইনি। তাকে লাফ দিতে বলি, যেন আমি তাকে ধরতে পারি।
সে আমার এই কথায় সাড়া দেয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ তাকে ঠেলে ফেলে দেয়। বাজেভাবে সে টারমাকে আছড়ে পড়ে, আমি তাকে কিছুটা ধরতে সক্ষম হই। আমি তখনো ওই সন্ত্রাসীর হাতে থাকা বিস্ফোরকের ভয়ে ভীত ছিলাম। বিমান থেকে যতটা সম্ভব দূরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা দৌঁড়ানোর মতো অবস্থায় ছিলাম না। যত দ্রুত সম্ভব আমরা দূরের টার্মিনালের দিকে হাঁটতে থাকি।বিমানটি অতিক্রম করার সময় সেটির ইঞ্জিন তখনও চালু ছিল। ঝড়ো গরম বাতাস আমার ও লিলির পায়ে আছড়ে পড়ে, আমরা আবারও পড়ে যাই। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে, আমরা ইঞ্জিনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাইনি। এই সময়ে লিলির গলা শুকিয়ে যায়। ও কথা বলতে পারছিল না। ওকে ফ্যাকাসে বা মৃতপ্রায় দেখাচ্ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে কেউ আমাদের দিকে দৌঁড়ো আসল। এবং অন্যকারও খাওয়া একটি অর্ধেক পানির বোতল লিলিকে দিল।এয়ারপোর্টে ফিরে আসার পর মুক্ত হওয়ার তীব্র অনুভূতি আমাকে গ্রাস করল। এই সময়ে আমার মনে পড়ে যে, আমরা পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাসসহ সব মূল্যবান সামগ্রী বিমানে ফেলে এসেছি। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় আমরা বেঁচে গেছি। আগের ৩০ মিনিটে অনেক ক্ষেত্রেই আমি নিজেকে বলেছি যে, এটাই, এভাবেই আমার জীবন শেষ হবে। কিন্তু কি এক কঠিন অবস্থা, মানুষ বলবে যে, তার অবসরের প্রথম দিনই ছিল তার জীবনের শেষ দিন।কিন্তু লিলি ও আমাকে নিয়ে সর্বশক্তিমানের পরিকল্পনা ভিন্ন। সেই পরিকল্পনা কি তা জানি না, কিন্তু আমি জানি এই অভিজ্ঞতার মতো আর কিছু হবে না।আমি বলতে চাই যে, এয়ারপোর্টের ঢোকার পরই আমাদের অগ্নিপরীক্ষা শেষ হয়। আমাদের ভালোভাবে দেখভাল করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, পরবর্তী ১২ ঘন্টা আমরাসহ মোট ১৫০ জন যাত্রীর ভোগান্তি চলতে থাকে।এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ বা বিমান এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে গল্প আরেক দিন বলবো.. কাজী মশিউর রহমান তার ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।