ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকের কঠিন বিচার দাবি জাহালমের

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সোমবার ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:২২ অপরাহ্ন
ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকের কঠিন বিচার দাবি জাহালমের

তিন বছর পর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা ৩৩ মামলার নিরপরাধ আসামি জাহালম। গতকাল রোববার দিবাগত রাত ১টার দিকে তিনি কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ থেকে মুক্তি পান। এ সময় তাঁকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই শাহানূর মিয়া।

জাহালমকে দেখেই সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘জাহালম বলবেন, কেমন লাগছে আপনার?’

জাহালম বলেন, ‘এখন আমার অনেক ভালো লাগছে। আমি তিন বছর পর জেল থেকে বাইর হইছি, এখন আমার অনেক ভালো লাগছে।’

জাহালম বলেন, ‘আমি কোনো অপরাধ না কইরা আজকে তিন বছর দুদক আমারে আটকা রাখছে মামলা দিয়া, মিথ্যা মামলা দিয়া। আমি দুদকের কঠিন বিচার চাই।

এখন আমার অনেক ভালো লাগছে। অনেক খুশি লাগছে। কেননা আমি জীবনে চিন্তাও করতে পারি নাই আমি জেল থেকে বাইর হইতে পারমু, এত মামলা, মিথ্যা মামলা। অনেক কষ্টে দিন কাটছে। কষ্ট কইরা মানুষের কাপড়টাপড় ধুইয়া, ওয়ার্ডে সেবা কইরা, কাজ-কাম কইরা চলছি, একটু ভালো খাইছি।’

বিনা দোষে তিন বছর কারাগারে আটকে রাখায় ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে জাহালম বলেন, ‘আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হইছি। আমি ক্ষতিপূরণ চাই রাষ্ট্রের কাছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।’

জাহালম বলেন, ‘জজ স্যাররে বলছিলাম যে আমি এই মামলার আসামি না। আমি আবু সালেক (প্রকৃত আসামি) না, আমি জাহালম। কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস যায়নি (করেননি)। জজ সাহেব দেখছে যে, এই ছবি আর এই ছবি মিলছে, কয় আমি বলে সেই লোক। আর স্বাক্ষীরা তারাও বলে আমি সেই (আবু সালেক) লোক। কিন্তু আমি তো সেই সময় কোনো কিছু জানি না।’

আপনি কি তাদের বিরুদ্ধে বিচার চাইবেন জানতে চাইলে জাহালম বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে বিচার চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আমি আদালতরে (হাইকোর্ট) অনেক ধন্যবাদ জানাই। আর তাতে আমি অনেক খুশি হইছি।’

দুদককে সঠিক তদন্তের মামলার আসামি ধরার দাবি জানিয়ে জাহালম বলেন, ‘দুদক যেভাবে মিথ্যা মামলা দিয়া মানুষরে হয়রানি করতাছে, দুদক হইলো এক নম্বর জালিয়াত। সঠিক তদন্ত না কইরা যানি (যেন) লোক ধরে না তারা। সঠিক তদন্ত নিয়া তারপর লোকদের মামলার আসামি করুক।’

এ সময় তাঁর ভাই শাহানূর মিয়া বলেন, যাদের ভুলের কারণে তাঁর ভাই জেল খেটেছে তিনি তাদের বিচার ও ক্ষতিপূরণ চান। পরে একটি মাইক্রোবাসে উঠে দুই ভাই কারা এলাকা ত্যাগ করেন।

এর আগে রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন এবং তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে উপকারামহাপরিদর্শককে (ডিআইজ প্রিজন্স) নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে জাহালমকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে রাখার ঘটনায় দুদকের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেন আদালত। আদালত বলেন, বিনা দোষে জাহালমকে কারাগারে রাখা আরেকটি জজ মিয়ার নাটকের মতো ঘটনা।

এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেন, এক নির্দোষ লোককে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না। ঘটনার সঙ্গে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকলে খুঁজে বের করতে হবে। হাইকোর্টের আদেশ শোনার পর জাহালমের ভাই বিকেল ৪টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে ছুটে আসেন এবং কারাগারের ফটকে অপেক্ষা করতে থাকেন।

শাহানূর মিয়া তখন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ভাই আমার বুকে আসতেছে এটা বড় আনন্দ। আমার ভাই বিনা অপরাধে বিনা দোষে জেল খাটল। রাষ্ট্রের কাছে সঠিক বিচার চাই। যারা এটার তদন্ত করছে আইনের আওতায় এনে তাদের সঠিক বিচার হওয়া উচিত। যদি এটা প্রমাণ না করতে পারতাম, আমার ভাইয়ের ৪০০ বছর জেল হইয়া যাইত। দুদকের প্রসিকিউটর এবং দুদকের অফিসাররা বলছে, যদি আবু সালেককে না পাওয়া যেত তাহলে জাহালমের সর্বনিম্ন সাত বছর প্রতি মামলায়, আর সর্বোচ্চ ১২ বছর সাজা হতো। তার মানে আমি হিসাব করে দেখলাম, আমার ভাইয়ের ৩৯৬ বছর সাজা হতো। আমার ভাইরে আমি জীবনেও কাছে পেতাম না।’ এ জন্য তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ জানান।

তাৎক্ষণিক আদেশ পৌঁছায় রাতে

হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার দুপুরে জাহালমকে তাৎক্ষণিক মুক্তির আদেশ দিলেও তা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায় রাত ১২টা ৫ মিনিটে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ২-এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা জানান, আদালতের দেওয়া মুক্তির আদেশ কারা মহাপরিদর্শকের দপ্তরের মাধ্যমে রাত ১২টা ৫ মিনিটের দিকে কাশিমপুরের এ কারাগারে পৌঁছায়। পরে তা যাচাই-বাছাই ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে জাহালম ওরফে জানে আলমকে মুক্তি দেওয়া হয়।এর আগে ২০১৬ সালের ৬ জুন জাহালমকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ওই বছরের ২৭ মে তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

গত ২৮ জানুয়ারি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ৩৩টি মামলায় নিরপরাধ জাহালমের জেলখাটা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন পাটকল শ্রমিক জাহালম। প্রতিবেদনটি সেদিন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট অমিত দাস গুপ্ত। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার দুদকের মহাপরিচালক (আইন) মইনুল ইসলাম, দুদকের মামলার বাদী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের একজন প্রতিনিধি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের মনোনীত প্রতিনিধিকে আদালত তলব করেন। রোববার সকালে ওই চারজন হাইকোর্টে হাজির হন।

মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত

নির্দোষ জাহালমকে গ্রেপ্তারের পর তার ভাই শাহানূর মিয়া দুদকের কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, তাঁর ভাই নিরপরাধ। কিন্তু কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। এরপর জাহালমের ভাই শাহানূর গত বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে যান। শাহানূরের অভিযোগ পেয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ছুটে আসেন কাশিমপুর কারাগারে। কথা বলেন জাহালমের সঙ্গে। তিনি নিশ্চিত হন, জাহালম তাঁতকল শ্রমিক। বাংলায় কোনো মতে স্বাক্ষর করতে জানেন। ব্যাংক জালিয়াতি মামলার আসামি সাগর আহম্মেদ তাঁকে জানান, প্রকৃত আসামি সালেককে তিনি চেনেন। মানবাধিকার কমিশন তখন আসামি সালেকের জীবন বৃত্তান্ত জানতে চেয়ে ঠাকুরগাঁও স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি লেখেন। একইভাবে কারাগারে থাকা জাহালমের জীবন বৃত্তান্ত জানতে চেয়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের প্রশাসনকে চিঠি লেখেন। স্থানীয় প্রশাসনের পাঠানো প্রতিবেদনে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নিশ্চিত হন, ব্যাংকের টাকা জালিয়াত চক্রের প্রকৃত আসামি সালেকের সম্পদ বেড়েছে। কিনেছেন জমিও। উল্টো দিকে জাহালমের পরিবার হতদরিদ্র। ভিটে ছাড়া আর কোনো জমি নেই।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, তাঁদের তদন্তে যখন জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হন তখন চিঠি দিয়ে দুদককে জানানো হয়। কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। অধিকতর তদন্ত করার অনুরোধ করেন। দুদক অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। দুদকের তদন্তে উঠে আসে, জাহালম নিরপরাধ। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতের কাছে আবেদন করেন।

ইনিউজ ৭১/এম.আর