১৮ডিসেম্বর ওড়েছিল বিজয়ের পতাকা, নওগাঁবাসী পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: রবিবার ১৮ই ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০৩ অপরাহ্ন
১৮ডিসেম্বর ওড়েছিল বিজয়ের পতাকা, নওগাঁবাসী পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ

১৯৭১সালের ১৬ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও বেশ কিছু জেলা অবরুদ্ধ করে  রেখেছিল পাকিস্তাহী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। নওগাঁ জেলা ছিল সেগুলোর মধ্যে একটি। আজকের এই দিনে মুক্তির স্বাদ পায় নওগাঁ জেলাবাসী। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল নওগাঁ। পরদিন ২২ এপ্রিল নওগাঁ পাক হানাদারদের দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে পাক হানাদার বাহিনীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন তা-ব চালায়। শত শত মুক্তিকামী  মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানী হায়েনারা। 


সীমান্তবর্তী নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধ হয় পাক বাহিনীর। সর্বশেষ ১৯৭১ এর ১০ ডিসেম্বর জেলার রানীনগর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন এলাকা ১২ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। এ সময রানীনগর ও সান্তাহারে অবস্থানরত পাক বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর রাতের মধ্যে নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁ, কেডি স্কুলে আশ্রয় নেয়। এ সময় হানাদার বাহিনী নওগাঁ শহরের সাবেক থানা চত্বর, আদালত পাড়া ও এসডিও বাসভবন চত্বরে আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলে।


১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকার রেসর্কোস ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান )আত্মসমর্পণ করে। এ খবর শোনার পরও নওগাঁয় পাক হানাদাররা অত্মসমর্পণ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টার দিকে প্রায় ৩৫০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নওগাঁ শহর ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা ওইদিন জগৎসিংহপুর ও খলিশাকুড়ি গ্রামে অবস্থান নিয়ে পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় পাকা হানাদাররা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। এভাবে একটানা রাত ৮টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইচাহাক আলী খাঁন, ফরিদ হোসেন, আমজাদ হোসেন, ওসমান, শাহাদত আলী মীর ও কিশোর মুক্তিযোদ্ধা অছিম উদ্দিনসহ ৬জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়।


১৮ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ৮টার দিকে বগুড়া থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে পিবি রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করলে হানাদার বাহিনীর আর কিছুই করার ছিল না। ফলে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাকসেনা নওগাঁ শহরের কেডি স্কুল থেকে পিএম গার্লস স্কুল, সরকারি গার্লস স্কুল, পুরাতন থানা চত্বর এবং এসডিও অফিস থেকে শুরু করে রাস্তার দু’পাশে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারের কাছে।


এর পর তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানান। বর্তমান পুরাতান কালেক্টরেট (এসডিও) অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয়। সীমান্তের এই জেলায় এদিন ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা।


বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নওগাঁ জেলা ইউনিট এর সাবেক কমান্ডার হারুন অল রশিদ বলেন, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনের পাশাপাশি ১৮ ডিসেম্বর ‘নওগাঁ হানাদার মুক্ত’ দিবস পালন করা হলে তরুণ প্রজন্মরা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবেন। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। এ বিজয় অজর্নে অনেক রক্ত দিয়ে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সবাইকে জানার আহব্বান জানান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।


নওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ এর সভাপতি এ্যাডভোকেট ডি এম আব্দুল বারী বলেন, প্রতিবছর এ দিনটিকে ‘নওগাঁ হানাদার মুক্ত দিবস’ হিসেবে আমরা পালন করে থাকি। অলোচনাসভা, র‌্যালি, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের অনুষ্টানের আয়োজন হয়ে থাকে। তবে আমরা আশা করছি সরকারি ভাবেও যেন নওগাঁ হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হয়।