পদ্মা সেতু যোগাযোগ ও বাণিজ্যের আশীর্বাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার ২৯শে জুন ২০২২ ০৭:৩৫ অপরাহ্ন
পদ্মা সেতু যোগাযোগ ও বাণিজ্যের আশীর্বাদ

দুই দশকের ঐতিহাসিক যাত্রা শেষে বাংলাদেশের বুকে স্থাপিত হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। পদ্মা এখন বাংলাদেশের বৃহৎ সেতু। গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মেগা-অবকাঠামোটির শুভ উদ্বোধন করেন।


পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা)। এ সেতুর ফলে আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডেপি) বছরে ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের চাকরি, চাকরির ক্ষেত্র ও পর্যটক বাড়বে।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, এ মেগা-কাঠামোটি থেকে মাত্র এক বছরে জিডিপিতে ৪২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকারও বেশি যোগ হবে (৪.৫৬ বিলিয়ন ডলার)।


পদ্মা সেতু বিশ্বের গভীরতম সেতু। এর পাইল পদ্মা নদীতে ১২০-১২৭ মিটার গভীরে বসানো হয়েছে। এটির স্প্যান বসাতে বিশ্বের বৃহৎ ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করা হয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতল বহুমুখী এ সেতুটিতে নিচে রেল চলাচলের ব্যবস্থা ও ওপরে চার লেনের হাইওয়ে সড়ক রয়েছে।


বিশ্বব্যাংকের প্রস্থান ও নিজস্ব অর্থায়ন


বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে একটি সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত করার স্বপ্ন একসময় অধরা বলে মনে হয়েছিল। প্রকল্পে দুর্নীতি কেলেঙ্কারির কারণে ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিল করে। অন্যান্য ঋণ সংস্থাও এ মেগা প্রকল্পটি থেকে বেরিয়ে আসে।


আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো সহায়তা ছাড়াই এ সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে অনেক বিশ্লেষক সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু এ মাসে পদ্মা সেতুর সমাপ্তি এবং এর জমকালো উদ্বোধন দৃশ্যত লাখ লাখ বাংলাদেশির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করেছে।


চীনের বিআরআই এই সেতুর অংশ নয়


আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটা খুবই সুপরিচিত যে চীন একটি বৃহৎ আন্তঃমহাদেশীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার নাম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- এশিয়ার অন্যান্য অংশের পাশাপাশি আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে একটি আন্তঃমহাদেশীয় স্থলপথ ও সামুদ্রিক নেটওয়ার্ক গড়া।


পদ্মা বহুমুখী সেতুকে চীনের ফ্ল্যাগশিপ বিআরআয়ের অংশ হিসেবে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল। জবাবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এ মেগা-প্রকল্পটি বিদেশি তহবিল নিয়ে নির্মিত হয়নি এবং এটি বিআরআয়ের অংশ নয়। বরং সেতুটি সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অর্থায়নে তৈরি।


ঘণ্টা থেকে মিনিটে


এতদিন পদ্মা নদী পার হওয়া কঠিন ছিল। ফেরি ও লঞ্চে ওঠার আগে যানবাহন ও মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তারপর নদীর ওপারের জেলাগুলোতে যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগত।


আবহাওয়া খারাপ থাকলে, গাড়ির ওজন বেশি হলে নদী পার হতে আরও বেশি সময় লাগতো। তবে এখন সেতু তৈরির ফলে পদ্মা পাড়ি দিতে লাগে মাত্র সাত থেকে আট মিনিট।


নতুন বাজার


যদিও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তবে পদ্মা নদী একটি বড় ভৌগলিক বিভাজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিভাজনের কারণে জেলে, মাছ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও মাছ ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করতে অসুবিধায় পড়তেন।


উত্তরের বাজারে পরিবহন খরচ বেশি ছিল, বিক্রির দাম কম ছিল। তাই দীর্ঘ সড়ক পরিবহন ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন খরচের কারণে মাছ চাষি ও ব্যবসায়ীরা শুধু নিকটবর্তী জেলায় মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ফসল ও ফল বাণিজ্যেও একই ধরনের সমস্যা হয়।


সৌভাগ্যবশত, এ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষক, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা এখন সহজেই ঢাকা ও অন্যান্য আশপাশের উত্তরের জেলার বাজারে প্রবেশ এবং পদ্মা সেতুর কারণে তাদের পণ্য বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে।


উদাহরণস্বরূপ, ইলিশ বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশের একটি বিখ্যাত এবং উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন মাছ। এ মাছ এখন ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রির আভাস পাওয়া গেছে।


পর্যটনের সুযোগ


দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর স্থানীয়রা সব সময় পর্যটন থেকে উপকৃত হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ জেলাগুলোর সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প আশার আলো তেমন দেখেনি।


এখন যেহেতু পদ্মা সেতুর কারণে এ জেলাগুলোর সঙ্গে চমৎকার সংযোগ স্থাপন হয়েছে। তাই প্রতি বছর এ অঞ্চলে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় ও জাতীয় উভয় সরকারের রাজস্ব বাড়বে। জেলাগুলোতে বিদ্যমান হোটেলগুলো পর্যটন থেকে বেশি লাভের আশা করছে। এ ছাড়া বড় বড় হোটেল, মোটেল ও রেস্ট-হাউসগুলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে ব্যবসা খোলার লাইসেন্সের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।


সূত্র: এশিয়া টাইমস, ভাষান্তর: পাপলু রহমান


লেখক: বাহাউদ্দিন ফৌজি, ঝুঁকি বিশ্লেষক