ইট, বালি ও সিমেন্টের আধুনিকতার ভিরে ১০৮কক্ষের বিশাল মাটির বাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: রবিবার ১৪ই মার্চ ২০২১ ০৩:৩৫ অপরাহ্ন
ইট, বালি ও সিমেন্টের আধুনিকতার ভিরে ১০৮কক্ষের বিশাল মাটির বাড়ি

আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামেও লেগেছে আধুনিকার ছোয়াঁ। শহরে যেমন গড়ে উঠেছে ইট-পাথরে গড়া অট্রালিকা,তেমনইভাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছোট-বড় ইট পাথরের বাড়ি গড়ে উঠছে।


তার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে চিরাচিরায়িত মাটির বাড়িগুলো। তবে কিছু কিছু গ্রামে এখনও দেখা মিলে ছোট ছোট মাটির ঘর। শীত ও গরমের সময় বেশ আরামদায়ক হওয়ায় এক সময় গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক টাকা ব্যয় করে মাটির বাড়ি তৈরি করতেন। তবে ইট, বালি ও সিমেন্টের এ আধুনিকতায় মাটির বাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু এক সঙ্গে ১০৮টি কক্ষের মাটির বিশাল বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর মহাবেপুরের আলীপুর গ্রামে। 


নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮কিলোমিটার দূরে মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়ন এর ছোট্র একটি গ্রাম আলীপুর। এ গ্রামের প্রয়াত তাহের আলী মন্ডল ও তার ছোট ভাই শমসের আলী মন্ডল শখের বসে ৩৪ বছর আগে ১৯৮৬সালে একটি পুকুর খনন করে সেখানকার মাটি দিয়ে প্রায় ৬বিঘা জমির উপর নির্মান করেন ১০৮কক্ষ বিশিষ্ট মাটির বিশাল বাড়ি।


বাড়ি ৬বিঘা, বাড়ির সামনে পুকুর ৮বিঘা এবং আঙ্গিনা ৩বিঘা মোট ১৭বিঘা জমিতে পুকুর ও বাড়ি তৈরি করা হয়। বিশাল এই দোতলা বাড়িটির দৈর্ঘ্য ৩০০ ফিট এবং প্রস্থ ১০০ ফিট। বাড়িটির সৌন্দর্য বাড়াতে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেয়া হয়েছে। যার কারনে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রথম দেখায় যে কাউকে বাড়িটি আকৃষ্ট করবে। 


প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বাড়িটি এক পলক দেখার জন্য আসে নানা বয়সী মানুষ। নওগাঁ শহরের থানার মোড় থেকে বাড়িটি দেখতে এসেছেন রাজু হোসেন এসময় কথা হয় তার সাথে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় লোক মুখে ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়িটির কথা শুনেছি তবে নওগাঁয় বসবাস করলেও আগে কখনো আসা হয়নি, এবারই প্রথম বাড়িটি দেখতে আসলাম। বর্তমানে তো ইট-পাথর দিয়ে বাড়ি নির্মান হচ্ছে। মাটির বাড়ি খুব একটা চোখে পড়েনা। তাছাড়া একসাথে ১০৮টি ঘর। যা দেখে খুবই অবাক হয়েছি। দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল।


পাশ্ববর্তী বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার শান্তাহার থেকে পরিবার নিয়ে বাড়িটি দেখতে এসেছেন ব্যাংকার সুরাইয়া খাতুন সেফা, তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে ঢাকাতে থাকি কয়েক দিনের জন্য ছুটিতে এসেছি, এই ফাঁকে ১০৮কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটা দেখতে এসেছি। প্রথম দেখায় মনটা ভরে গেল এত বিশাল বাড়ি আমি আগে কোনদিন দেখিনি। আর দেশে ১০৮কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি আছে কিনা আমার জানা নেই। 


তিনি আরও বলেন, এটি একটি পর্যটন এলাকা হতে পারে বাড়িটিকে ঘিরে। সরকার যদি বাড়িটির আশে-পাশে বসার জায়গা, ঘুরতে আসাদের নিরাপত্তাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে পারে তাহলে আরও বেশি মানুষের সমাগম হবে বলে মনে করি।


নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়লিয়া এলাকা থেকে ঘুরতে আসা শাকিরুজ্জামান বলেন,  বর্তমান তরুন প্রজন্মের অনেকই হয়তো জানেই না মাটির দোতলা বাড়ি তৈরী করা যায়। এখানে এসে আমার সন্তানদের ঘুরে-ঘুরে দেখালাম। তাছাড়া আমি নিজেও এখানে না এলে জানতামই না যে মাটি দিয়ে এত বিশাল বাড়ি নির্মান করা যায়।


বাড়িটির মালিক মৃত শমসের আলী মন্ডল এর  ছেলে ফারুক হোসেন মন্ডল জানান, ১৯৮৬ সালে আমার বাবা এবং আমার চাচা মৃত তাহের আলী আকন্দ অনেকটা শখের বসে ১০৮কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটি নির্মান করেছিলেন। এজন্য তারা মোট ১৭বিঘা জমি নির্ধারণ করেন।


৮বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেন মাটি ও পুকরের জন্য এবং ৬বিঘা জমিতে বাড়ি নির্মান কাজ শুরু করেন। ১৫০জন নির্মান শ্রমিক কাজ করেছিলেন। প্রায় ৯মাস সময় লেগেছিল পুরো বাড়ি নির্মান কাজ শেষ করতে। বাড়ি নির্মানে মাটি, খর, তাল গাছের তীর,বাঁশ, টিন ও কাঠ ব্যবহার করা হয়েছিল। 


তিনি আরও বলেন, ১০৮ কক্ষের এই বাড়িতে প্রবেশের দরজা ৭টি। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় উঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। ৯৬টি বড় ও ১২টি ছোট কক্ষ রয়েছে বাড়িতে। বর্তমানে আমার বাবা ও চাচার পরিবারে মোট ৪০জনের মত সদস্য এই বাড়িতে বসবাস করছি।


মৃত তাহের আলী মন্ডলের নাতী সাকিব আলী মন্ডল বলেন, আমার দাদাদের অনেক শখের এই ১০৮ কক্ষের বাড়িটি। পায়ে হেঁটে একবার বাড়ির চার ধারে ঘুরে আসতে  সময় লাগে ৬ থেকে ৮ মিনিট। বর্তমানে বাড়িটিতে আমার বাবা, চাচা ও ফুফুদের পরিবার মিলে ৪০জন  সদস্য বসবাস করে আসছি। 


তিনি বলেন, বাড়িটি ঘিরে দাদাদের অনেক স্মৃতি জমা আছে তাই আমরা এই মাটির বাড়ি কখনো ভাংবো না। দাদাদের স্মৃতি বিজরিত এই মাটির বাড়িতেই আমরা বসবাস করে যেতে চাই ।


স্থানীয় চেরাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী শবিনাথ মিত্র  বলেন, আলীপুরের ১০৮কক্ষের বাড়িটি দেখতে প্রতিদিনই অনেক মানুষের সমাগম হয়। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন উদ্ধতন কর্মকর্তারা নওগাঁতে আসলে বাড়িটি দেখতে চাইলে আমি তাদের নিজেও বাড়িটি দেখাতে নিয়ে যাই। যাতে মানুষ সহজে যেতে পারে সে জন্য নওগাঁ-মহাদেবপুর রোডের পাকা রাস্তা থেকে আলীপুর ওই বাড়ি পর্যন্ত একটি ছোট এসবিবি রাস্তা নির্মান করা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে।


তিনি আরও বলেন, সরকারি ভাবে যদি উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এই বাড়িটি একটি পর্যটন স্থান হতে পারে। কিন্তু বাড়িটির উত্তরসূরিদের সাথে আমি বেশ কয়েক বার কথা বলেছি তারা সেভাবে চাইনা এখানে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে অবকাঠামোগত উদ্যোগ নেয়া হোক। অনেক মানুষ আসবে প্রতিদিন বাড়ির চারপাশে অনেকে বসবে বাড়িতে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখতে চাইবে,হয়তো সে কারনেই তারা চাচ্ছেনা। তবে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিন তরফদার ও ইউএনও মহোদয়ের সহযোগিতায় বাড়িটিকে ঘিরে কিছু উন্নয়ন করার যাতে পর্যটনের স্থান হিসেবে কিছু করা যায়।