ঝিনাইদহের বলুহর বাওড়পাড়ে মৎস্যজীবীদের মানববন্ধনে আহাজারী

নিজস্ব প্রতিবেদক
আতিকুর রহমান, জেলা প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: সোমবার ২৩শে জানুয়ারী ২০২৩ ০৬:২৬ অপরাহ্ন
ঝিনাইদহের বলুহর বাওড়পাড়ে মৎস্যজীবীদের মানববন্ধনে আহাজারী

ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় রক্ষায় হালদার সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিন তারা বাওড় পারে মানববন্ধন ও সমাবেশ করছেন। গতকাল সোমবার কোটচাঁদপুরের বলুহর প্রজেক্ট এলাকায় এমন মানববন্ধনে হাজির হন ৭৭ বছর বয়সী শ্রী নরেন হালদান, যার ৬৮ বছরই কেটেছে জাল দড়া টেনে। মানববন্ধনে হালদার সম্প্রদায়ের কয়েক’শ মানুষ উপস্থিত হয়ে তাদের পেটে লাথি না মারার আকুতি জানান। 


মানববন্ধনে সুধীর হালদার নামে এক মৎস্যজীবী বস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, হালদার সম্প্রদায় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে বলে এসেছেন “হয় বিষ দ্যান না হয় বাওড়ের মালিকানা দ্যান”। বাপ দাদার কর্মক্ষেত্র বলুহর বাওড় ইজারা দেয়া হলে তারা সেচ্ছায় আত্মহুতির কর্মসুচি দিতে বাধ্য হবেন বলেও জানান এই মৎস্যজীবী। 


তাদের ভাষ্য, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমল থেকে তারা বাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও বৃহৎ একটি পরিবার তাদের আয়ের উপর নির্ভরশীল। জীবন সয়াহ্নে এসে তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন বলুহর বাওড়ের মালিকানা হারাতে বসেছে। 


তথ্য নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন টেন্ডারের মাধ্যমে বাওড়গুলো ইজারাদানের পক্রিয়া চালাচ্ছে। ফলে কর্ম হারানোর প্রহর গুনছেন বাওড়পাড়ের হাজারো মৎস্যজীবী পরিবার। শুধু নরেণ হালদার নয়, তার মতো বাওড় পাড়ের রহমতপুর গ্রামের সাধন হালদার, বলুহর গ্রামের নিত্য হালদার, শ্রীমতি কমলা রানী হালদার, বজরাপুর গ্রামের সন্তোষ কুমার হালদারসহ জেলার ৬টি বাওড়ের উপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা। 


মৎস্যজীবীরা জানান, সরকারের ভুমি মন্ত্রনালয় ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং বেড়গোবিন্দপুর। এ সব বাওড়ের মোট জলাকার হচ্ছে ১১৩৭ হেক্টর। 


৬টি বাওড় এলাকায় ৭৬৭টি পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য এ সব বাওড় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। মৎস্যজীবীরা সরকারের “জাল যার জলা তার” এই নীতির উপর ভর করে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বাওড়ে মাছ ধরে আসছিলেন। 


সুফলভোগী মৎস্যজীবী সুধীর হালদার জানান, বাওড় ইজারা দিলে সরকারের এককালীন বেশি টাকা আয় হলেও একদিকে যেমন বাওড়গুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি মালিকানা হারিয়ে পথে বসবে বাওড়ের উপর নির্ভরশীল হাজারো পরিবার। ফলে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। বাওড়গুলো চলে যাবে প্রভাবশালী মধ্যসত্বভোগীদের দখলে। ইতিমধ্যে একটি মাফিয়াচক্র বাওড়গুলো ইজারা নিতে কোমর বেধে মাঠে নেমেছে। 


ভুইফোড় সমিতির নামে কোটি কোটি টাকার ডাক তুলে সিডি জমা দেয়া হয়েছে। সুধীর হালদার অভিযোগ করেন, কোটচাঁদপুরের শীতল হালদার নামে এক ব্যক্তি দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিপরীতে সিডি জমা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই টাকার জোগানদাতা কারা ? শীতল হালদারের পেছনে কারা টাকার যোগান দিচ্ছে ? এ বিষয়ে বিল বাওড় প্রকল্প পরিচালক মোঃ আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে বর্তমান প্রকল্পের মেয়ার বৃদ্ধি করে চলমান নিয়মে মাছের চাষ করা। 


কিন্তু ভুমি মন্ত্রনালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা চুড়ান্ত ভাবে বাস্তবায়িত হলে হাজারো হালদার পরিবার পথে বসবেন। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, বাওড়পাড়ের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে ভুমি মন্ত্রনালয় মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষের জন্য দিয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা আনতে পারেনি। বাওড়পাড়ের হলদারদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন বলে তিনি জানান। 


বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর মহেশপুর এলাকার সংসদ সদস্য এ্যাড শফিকুল আজম খান চঞ্চল জানান, আগামী ৩১ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে আন্তঃ মন্ত্রনালয়ে সভা হবে। সেখানে বিষয়টি উঠবে। তিনি বলেন, বাওড়গুলো ইজারা দিলে সরকার হয়তো এককালীন টাকা পাবে, কিন্তু হালদার পরিবারগুলো কোথায় যাবে ? এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মানবতা ভুলুন্ঠিত হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানান, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাওড় রক্ষায় যা যা করার তাই তিনি করবেন।