খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে মা কারাগারে, কাঁদছে দুধের শিশু

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৫শে আগস্ট ২০২২ ১২:০২ অপরাহ্ন
খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে মা কারাগারে, কাঁদছে দুধের শিশু

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী বলদিপাড়া-হলদিঘর গ্রামের অজুফা খাতুন খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে চার দিন ধরে কারাগারে। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই কান্না থামছে না তিন বছর বয়সী শিশু মরিয়মের।


রোববার (২১ আগস্ট) প্রশাসনের উপস্থিতিতে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর মরিয়মের কান্না কিছুতেই থামছে না।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষের বসবাস এই গ্রামে হলেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছাড়া সবাই। মানুষের হাসিখুশিতে ভরপুর কয়েক দিন আগের গ্রামটি এখন জনশূন্য হয়ে গেছে। এই সুযোগে প্রতি রাতেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে গরুছাগলসহ মালামাল।


লুকিয়ে থাকা বলদিপাড়া গ্রামের আতিকুল ইসলাম, শুকুর মাহমুদ, আল মাহমুদসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী বলদিপাড়া-হলদিঘর মাঠই শিশুদের একমাত্র ভরসা। এখানে ফুটবল অনুশীলন করে অনেকের জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত খেলার সুযোগ হয়েছে। সেই মাঠেই আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে চায় উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন এলাকাবাসী। সব দাবি উপেক্ষা করে রোববার (২১ আগস্ট) প্রকল্পের মাটি ভরাট করতে গেলে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা।


এ সময় প্রশাসনের লোকজন স্থানীয়দের ওপর হামলা করলে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীসহ আহত হন ছয়জন। পরে আত্মরক্ষায় গ্রামবাসীও ইট নিক্ষেপ করলে আহত হন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। এ ঘটনার পরেই উপজেলা ভূমি অফিসের পেশকার আব্দুল হাই অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে শাহজাদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।


মামলায় বেআইনিভাবে সরকারি কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর, পরিদর্শনরত অ্যাসিল্যান্ড লিয়াকত সালমানকে হত্যার উদ্দেশে মারধরসহ ১০টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে সাতজন নারী এবং দুজন পুরুষকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেন। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই গ্রেপ্তার এড়াতে সটকে পড়েন গ্রামের অধিকাংশ নারী ও পুরুষ।


এদিকে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শাহজাদপুর উপজেলার ১ নম্বর কায়েমপুর ইউনিয়নের বলদিপাড়া-হলদিঘর গ্রামের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার অনুরোধ জানিয়ে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের পক্ষ থেকে গ্রিন ভয়েসের সমন্বয়কারী আলমগীর কবীরের সই করা বিবৃতিতে এ অনুরোধ জানানো হয়।


বিবৃতি দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ও বাপার সভাপতি সুলতানা কামাল ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।


বিবৃতিতে তারা খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার অনুরোধের পাশাপাশি রোববার (২১ আগস্ট) প্রশাসনের উপস্থিতিতে সহিংসতা, দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা স্থানীয় জনগণের হয়রানি ও আহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, স্থানীয় এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃত নারীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।


অজুফা খাতুনের ছেলে কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, মা শুধু চেয়েছিলেন আমাদের স্মৃতিবিজড়িত খেলার মাঠ দখল করে যেন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প না করা হয়। তিনি হাজার হাজার গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে ছিলেন, খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প চাই না। সেই চাওয়াই তার জন্য কাল হয়।


এই একই মামলায় স্থানীয় মুদি দোকানি আনছার আলীর স্ত্রী মালেকা খাতুন ৩ বছর বয়সী মেয়ে আফিয়াকে সঙ্গে করেই গেছেন কারাগারে। আর পুলিশের ভয়ে আনছার আলী বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ।


তিনি আরও জানান, এ মামলায় কারাগারে রয়েছেন দরিদ্র ভ্যানচালক আল মাহমুদের স্ত্রী ঝরনা খাতুন। দিনমজুর আব্দুল মজিদের স্ত্রী সেলিনা বেগম। সাত বছর বয়সী এক প্রতিবন্ধী সন্তানের জননী হোসনে আরা, বৃদ্ধ জামাল প্রামাণিকের অসুস্থ স্ত্রী আকলিমা, কৃষক আব্দুল আলীমের স্ত্রী শাফিয়া খাতুন। গণহারে পুলিশের এই গ্রেপ্তার আতঙ্কে এখন নারী ও পুরুষ শূন্য পুরো গ্রাম।


গ্রেপ্তারকৃত ওজুফা বেগমের মা জহুরা বেগম বলেন, আমার মেয়ের কি অপরাধ ছিল জানি না। আমার বয়স হয়েছে, আমি অসুস্থ। মরিয়ম মায়ের জন্য কান্না করেই যাচ্ছে। বুকের দুধ না পেয়ে রাতে ঘুমের মধ্যে কান্না করে উঠছে । এখন আমি কি করব বুঝতে পারছি না।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শাহজাদপুর থানার ওসি (অপারেশন ও কমিউনিটি পুলিশিং) আব্দুল মজিদ জানান, এখন পর্যন্ত নয়জন নারীসহ মোট ১১ জনকে আটক করা হয়েছে। নতুন করে আর কেউ আটক হয়নি।


সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) জানান, মাতৃদুগ্ধ পান করা শিশুর মাকে কোনো অবস্থাতেই আদালতের আদেশ ছাড়া গ্রেপ্তার করা যাবে না। এটি আইনের চরম লঙ্ঘন।