অসহায় মায়ের স্বপ্ন কেরে নিলো বিথী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বুধবার ২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০২:৩৯ অপরাহ্ন
অসহায় মায়ের স্বপ্ন কেরে নিলো বিথী




২০ বছর আগে স্বামী হারা ৩ মাসের একমাত্র ছেলে পারভেজকে নিয়ে বেশ সাহসী ছিলেন ৫০ বছরের  বকুল বেগম। স্বামীকে হারানোর পর ৩ মাসের ছেলের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে আর নতুন কোন সংসার করেন নি তিনি। ২০ বছর ধরে নিজে খেয়ে না খেয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কখনো ভিক্ষা করে ছেলেকে বড় করেছিলেন বকুল বেগম। 


ছেলেও থাই গ্লাসের কাজ শিখে উপার্জন করে মায়ের দুঃখ মুছে দিয়েছিলেন। বকুল বেগমও দীর্ঘদিন কষ্টের পর শান্তির নিশ্বাস নিতে শুরু করেছিলেন ছেলের ভরসায়। তবে সেই সুখ আর কপালে ঝুটলনা বকুল বেগমের। গত ২৩ জানুয়ারি নৃশংস এক হত্যাকান্ডে খুন হয় ছেলে পারভেজ। 

আলো-আধাঁরে, শত ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে ২০ বছর ধরে আগলে রাখা ছেলেকে এক নিমিষেই হত্যা করা হয়। 



২০ বছর ধরে আগলে রাখা ছেলে আদরের ধনকে  কবরে মাটির নিচে শুইয়ে থাকা দেখে মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেনি বকুল। ছেলের কবর দেখার পরই শোকে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ হয় তার। পরে বকুল বেগমের শরীরের পুরো অংশই অবশ হইয়ে যায়। নড়াচড়ার কোন উপায় নেই। 



একদিকে বুকের ধন ছেলে হারা, অন্যদিকে নিজে চলতে পারে না। এখন ঘরভিটাহীন বকুল বেগম আশ্রিত দরিদ্র বোনের কুড়ে ঘরে। স্বামী হারা সামর্থহীন বোনের ঘরে হয়তো থাকতে পারবেন কয়েকটা দিন। কিন্তু তারপর কি করবেন বকুল বেগম? জীবনের এমন অনিশ্চয়তা আর ছেলে হারানোর কষ্টে প্রতি মুহূর্তেই চোখের জল ফেলছেন  তিনি।


একের পর এক স্বপ্ন ভঙ্গে জীবন যুদ্ধে পরাজিত আজ বকুল বেগম। সংসার জীবনের বছর খানেক অতিবাহিত হতে না হতেই ৩ মাসের সন্তান পারভেজ কে রেখে মারা যায় স্বামী মানিক মিয়া। নিরুপায় বকুল বেগম সেই ছোট্ট শিশু পারভেজকে নিয়ে নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে। ধামরাইয়ের চৌহাট এলাকা থেকে

চলে আসেন সাভারে। মানুষের বাসায় কাজ করে, কখনো ভিক্ষা করে অবলম্বন হিসাবে বড় করে তুলেছিলেন তার সন্তানকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কথিত স্ত্রীর ছুড়িকাঘাতে খুন হয় পারভেজ। বকুলের জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ঘনঘটা।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে বকুল বেগম ৩ মাসের সন্তানকে নিয়ে সাভারের রাজাশন এলাকায় এসে বাসা বাঁধেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য একটাই ছেলেকে বড় করে তোলা। তিলে তিলে অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে সফলও হয়েছিলেন তিনি। ছেলেকে কাজের জন্য একটি একটি করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি  কিনে দিয়েছিলেন। ছেলেকে শিখিয়েছিলেন থাই গ্লাসের কাজ। 


কাজের সুবাদে পারভেজের পরিচয় হয় বিথী নামের এক নর্তকীর সাথে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে নাচতেন বিবাহিত এই নারী। বকুল বেগমের অভিযোগ ফুসলিয়ে তার ছেলের সাথে সম্পর্ক করেন বিথী। পরে অজানা কোন এক কারণে পূর্বের স্বামীর সাথে হাত মিলিয়ে হত্যা করে পারভেজ কে।  



বকুলের বোন ফিরোজা বলেন, স্বামীকে হারিয়ে যখন দিনের পর দিন কষ্ট আর অভাব সীমাহীন, তখনও বকুল দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তা করে নি। তার আদরের সন্তান অনাথ হবে ভেবে। জীবনের সমস্ত সুখ, খুশি বিসর্জন দিয়েছিল। তিলে


তিলে বড় করেছে ছোট্ট অবুঝ শিশুকে। শিখিয়েছিল থাই গ্লাসের কাজ। বকুলের কোন চিন্তা ছিল না। ছেলে বড় হয়েছে, কাজ শিখেছে। জীবনের শেষ সময়ের স্বপ্ন ছিল বিশ্রাম। কিন্তু স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এক সন্ধ্যায়। হত্যা করা হয় তার ছেলে পারভেজকে। এর পরই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অবশ হয়ে যায় বকুলের হাত পা। 



ফিরোজা আরো বলেন, আমার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছে। আমি নিজেই খুব কষ্টে দিন পার করছি। বকুলের চিকিৎসা করবো কিভাবে। আমি বিত্তবানদের কাছে বকুলের চিকিৎসার জন্য দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।


বকুলের প্রতিবেশী হারুন জানান, গত ২৩ জানুয়ারি হত্যা করা হয় পারভেজকে। ২৪ জানুয়ারি সারাদিন হাসপাতালে থাকে মরদেহ। রাতে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকায় পাঠালে ২৫ তারিখ দাফনের জন্য পাঠানো হয় ধামরাইয়ের চৌহাটে। দাফনের পর দিন ২৬ জানুয়ারি পারভেজের কবরে যায় মা বকুল। এসময় হঠাৎ উচ্চ রক্তচাপে হাত-পা অবশ হয়ে যায় বকুলের। এখন তিনি রয়েছেন তার স্বামীহারা বোনের কাছে। তিনিও চিকিৎসা করাতে পারছেন না।


বকুল বেগম একটু পর পর কেঁদে ওঠেন। সারা দিনই তার চোখ দিয়ে ঝড়ছে কষ্টের জল। সারা দিন কথাও বলেন কম। কাউকে দেখলেই ছেলে বলে বুকে জড়িয়ে ধরেন।


 বকুল বেগম বলেন, আমার বুকের ধনকে যারা খুন করেছে তাদেরও একই রকম শাস্তি চাই। আমি হাত নড়াতে পারি না। চিকিৎসা করার লোকও নেই। আমার ছেলেটাকেও ওরা খুন করলো বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি। 


তিনি খুনীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার ছেলে যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে আমাকে বলতি। আমি নিজেই তার বিচার করতাম। তোরা একেবারেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলি। আমাকে এখন কে দেখবে। আমি তো এখন চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাবো। এক দিকে বুক খালি অন্যদিকে ছেলে নাই। আমি তো ঘুমাতেও পারি না। তিনি এই প্রতিবেদককেও বলেন, মাঝে মাঝে আমাকে দেখে যেও বাবা।


সুস্থ হলে হয়তো ছেলে হারানোর শোক একটু হলেও হালকা হবে বকুলের। সাহায্যের জন্য তিনিও জানিয়েছেন আকুতি। 


প্রসঙ্গত, বিথী নামের এক নর্তকীর সাথে পরিচয় হওয়ার পরে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে পারভেজ। পরে বিথীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে থাকতেন সাভারের কামাল গার্মেন্টস রোডের পাশের এক বাসায়। গত ২৩ জানুয়ারি কথিত স্ত্রী বিথী ও তার পূর্বের স্বামী রাহাতের সাথে হাত মিলিয়ে রাস্তায় ধাওয়া করে ছুড়িকাঘাতে হত্যা


করে পারভেজকে। এর পর অভিযুক্ত বিথী, বিথীর স্বামী ও জাহিদ নামের তিনজনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা স্বীকারোক্তি মুলক জবানবন্দিও দিয়েছেন আদালতে। তবে তাতে কি ফিরবে বকুলের পূর্বের অবস্থা। হাটতে পারবেন কি বকুল বেগম। এমন প্রশ্নই এখন বকুলের।