কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে বিউটি বোর্ডিং

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শনিবার ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:২৭ অপরাহ্ন
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে বিউটি বোর্ডিং

বিখ্যাত সব বাহারী খাবার ও পুরাতন স্থাপনার সাক্ষী এই পুরান ঢাকা। যার প্রতিটি কংক্রিটে লেগে আছে প্রাচীন ঢাকার নবাবি হাল-চাল। রাজধানীর পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের শ্রীশদাস লেনে  অবস্থিত বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং তেমনি একটি। 

একসময় হলদে রঙের দোতালা বাড়িটায় আড্ডা জমাতেন বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক ও গুণীজনেরা।বাড়িটির ভিতরে  ঢুকতেই প্রথমে আপনার নজর কাড়বে পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। হলুদ বর্ণের প্রাচীন আমলের বাড়িটির কংক্রিটের গাঁথুনি  আপনার স্মৃতিকে নিয়ে যাবে শতবছরের অতীতে, চোখে পরবে ফুলের বাগান তাতে বাহারী ফুলের মেলা,একঝাক ফুল যেন বাড়িটি আপনাকে বরণ করে নিবে।সিঁড়িগুলোয় লেগে আছে নবাবী ছোয়া,প্রাচীন স্মৃতির সবই লেগে আছে এই দোতালা বাড়িটির গায়ে।বিউটি বোর্ডিং এর রুমগুলোতে বিছানার পাশাপাশি আছে টেবিল ও চেয়ার এবং বেশিরভাগ রুমের পাশেই রয়েছে কারুকাজ ।কবি সাহিত্যিক সহ নানান পেশার মানুষ যেথায় আড্ডা জমাতেন চায়ের কাপে সেটির বর্তমান এই বিউটি বোর্ডিং।
বিউটি বোর্ডিং -এর ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাড়ি।প্রাককালে- ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে সেখানে ছিল সে সময়কার বিখ্যাত  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এই সোনার বাংলা পত্রিকায়। দেশভাগের সময়  এই সোনার বাংলা  পত্রিকার অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন  বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং। যেখানে আড্ডায় মেতে থাকতেন গুণীজনেরা।
বিখ্যাত এই হলদে রঙের বাড়িটি ১১ কাঠা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ করা বিউটি বোর্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ যুদ্ধচলাকালীন সময় বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন,এরা হলেন বিউটি বোর্ডিং এর সত্বাধীকারী প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা,ব্যবসায়ী সন্তোষ কুমার দাস,প্রকাশক হেমন্ত কুমার সাহা,ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অহিন্র চৌধুরী শংকর,শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র সাহা,সমাজসেবক নির্মল রায়,চিত্রশিল্পী হারাধন বর্মন,ব্যাবসায়ী প্রেমলাল সাহা,কেশব দাস ও শামসুল ইসলাম।অভিনেতা যোশেফ কোরায়া,বিউটি বোর্ডিং এর ম্যানেজার শীতল কুমার দাস,বিউটি বোর্ডিং এর পাচক অখিল চক্রবর্তী,অতিথি ক্ষিতীষ চন্দ্র দে,এলাকাবাসী নুর মোহান্মদ মোল্লা এবং বিউটি বোর্ডিং এর দুই কর্মচারী সাধন চন্দ্র রায় ও সুখ চন্দ্র দে।পরবর্তীতে প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারত গমন করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন।১৯৯৫ সালের ৪ঠা আগষ্ট গঠিত হয় বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ।২০০৩ সালের চৌঠা জুলাই কবি ইমরুল চৌধুরীকে প্রধান নির্বাহী ও তারেক সাহাকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ৬০ সদস্যা বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড।২০০৫ সাল হতে এখান হতে প্রতিবছর সন্মাননা দেওয়া হয়।
বিউটি বোর্ডং এর জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান এখানে বসে সভা করেছেন,দিয়েছেন নানান দিক নির্দেশনা।সমর দাস অনেক গানের সুর রচনা করেছেন এখান হতেই।এখানে বসেই জব্বার খান মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি রচনা করেন।১৯৫৭ সালে কবি ফজল শাহাবুদ্দিন প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা কবিকন্ঠ।১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবি শামসুল হক এখানেই লিখের,তার জন্য আলাদা টেবিল ছিল।এখান হতেই ১৯৫৯ সালে আহমেদ সফার সম্পাদনায় স্বদেশ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।যাদুকর জুয়েল আইচের যাদুর সূচনা এখান হতেই।এখানকার আড্ডাবাজদের বিউটিয়ান নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এখানে যারা আড্ডার আসরে আসতেন এদের কবি শামসুর রহমান,আবু হেনা মোস্তফা কামাল অন্যতম। এছাড়াও শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, আহমেদ ছফা,হায়াৎ মাহবুব, এনায়েত উল্লাহ খান, কবি।আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, গোলাম মুস্তাফা,  আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুর হক প্রমুখ।নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এখানে এসেছিলেন।
বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং এ এখন আগের মত আড্ডা না জমলেও অনেকের ভিড় দেখা যায়,ভ্রমনপিয়াসী ও ভোজনরসিক মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন।জানা যায়,বিউটি বোর্ডিং এ ২৫ টির মতো থাকার রুম আছে যার বেশিরভাগ এক বিছানা বিশিষ্ট।এখানে অনেকেই আসেন শখ করে আবার অনেকেই নিয়মিত থাকেন।প্রতিটি রুমের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাড়া নির্ধারিত,এর জন্য গুনতে হবে ২৫০-১২০০ টাকা পর্যন্ত।
সরষে ইলিশের জন্য এখানে ভিড় জমান ভোজনরসিকেরা।খাবারের ঘরে রয়েছে সারি সারি চেয়ার এবং টেবিল,রয়েছে স্টিলের থালা ও গ্লাস।বিউটি বোর্ডিংয়ে রয়েছে নানা পদের খাবার আয়োজন। অল্প টাকায় খেতে পারবেন দেশী খাবার। বিউটি বোর্ডিং এ খাবারের  তালিকায় রয়েছে ভাত, ডাল, শাকভাজি ও বিভিন্ন ভর্তা। মাছের মধ্যে সরিষা ইলিশ, রুই, কাতলা, চিতল,  বোয়াল, কোরাল মাছ,পাবদা, শিং, কৈ, মাগুর, চিংড়ি, আইড় মাছের ঝোল সহ নানা ধরণের পদ। এখানে সরষে  ইলিশের স্বাদ নিতে চাইলে আপনাকে গুনতে হবে  ১৬০-২০০ টাকা।  খিচুড়ি প্লেট প্রতি ৪০ টাকা, পোলাও প্লেট ৫০ টাকা, মুড়িঘণ্ট মাত্র ৭০ টাকা এবং মুরগি ও খাসির মাংস ৮০-১০০ টাকা।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব