বছরে ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মঙ্গলবার ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন
বছরে ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে

বাম গণতান্ত্রিক জোটের আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ধনিক শ্রেণি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করছে। এভাবে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে।
আরাফাত রহমান কোকোর টাকা ফেরত আনার পর মনে হয়েছিল অন্যদের টাকাও ফেরত আনা হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এক অদৃশ্য শক্তির কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরতের উদ্যোগ থেমে গেছে। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাম গণতান্ত্রিক জোটের আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট- উত্তরণের পথ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন বাম জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট উত্তরণে সভায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- খেলাপি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ খেলাপিকে চূড়ান্ত বিচারের সম্মুখীন করা; খেলাপিদের কথিত ভিআইপি/সিআইপি মর্যাদা বাতিল করা; রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে ঋণখেলাপিদের আমন্ত্রণ না করা; প্রতি মাসে গণমাধ্যমে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা; ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংক খাতের জন্য স্বতন্ত্র ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা; দলীয় বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে কাউকে নিয়োগ না করা; ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করতে ‘স্বাধীন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন’ গঠন করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশে চরম বৈষম্য চলছে। এটাকে কি উন্নয়ন বলা যায়? গড় আয় বেশি হলেই তো উন্নয়ন হয় না। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ধনীবান্ধব বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পদ্মা ব্যাংকের (ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কেন তাকে পদচ্যুত করা হল না? বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান একদিন আগে পদত্যাগ করলেন কেন?
বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে পদচ্যুত করল না কেন? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাটখোট্টা লোককে ব্যাংক গভর্নর করা হয়। বর্তমান গভর্নরের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। একজন কাটখোট্টা লোককে গভর্নর করেন। যিনি সৎ ও দলবাজি করবেন না।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জনগণ থেকে সরকারকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে গেলে, ভোট চাইলে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। আর যখন এমনি সব হয়ে যায় তখন দায়বদ্ধতা থাকে না।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ফারমার্স ব্যাংক রক্ষা করতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনেছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। দেশে খেলাপি ঋণ কত, তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল স্পষ্ট করে দেখিয়েছে। এর পরিমাণ ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, ব্যাংক খাত তদারকির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখন মাঠে গিয়ে খারাপ ঋণকে খেলাপি করতে পারেন না। উপরের সিদ্ধান্তের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়।
রেটিং প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মোজাফফর আহমেদ বলেন, রেটিং করায় ব্যাংকগুলোর ভেতরের খবর জানি। ব্যাংকগুলোয় কর্পোরেট গভর্ন্যান্স বলতে কিছু নেই।
চেয়ারম্যানরা ব্যাংক পরিচালনা করেন। পাঁচ শতাংশ মূলধন দিয়ে তারা পুরো ব্যাংক পরিচালনা করছেন। আমি মনে করি, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ৪০ শতাংশ। আলাদা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ সফল হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সত্যতা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক অবনমনের দিকে; তাহলে এত প্রবৃদ্ধি হল কিভাবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা দিন দিন এত ক্ষীয়মাণ হচ্ছে যে তা চিন্তাও করা যায় না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী এক নম্বর হয়েছেন। এর পরদিনই পরিস্থিতি খারাপ হল।
বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক মন্দার ভয়ংকর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমাদের অর্থনীতির সব সূচক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতি ধসে যাওয়ার উপক্রম। যারা এমন পরিস্থিতিতেও অর্থনীতিকে ভালো বলছেন, তারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ব্যাংক লুটপাট, ব্যাংক দখল ও পরিবেশ ধ্বংস এখন উন্নয়নের অংশ হয়ে গেছে। আর্থিক খাতের লুটপাটের জন্য কারা দায়ী সে প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বলেন, ঋণের বড় একটি অংশ নেয়া হচ্ছে তা পরিশোধ না করার জন্য। পরিশোধ করা হবে না জেনেও ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে।
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর যথাযথ ভূমিকা পালন করলে কি তাদের পদ টিকে থাকবে? তিনি আরও বলেন, ১০ বছরে নতুন প্রাইভেট ব্যাংক অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে আপত্তি এসেছে। বলা হয়েছে- আর ব্যাংকের দরকার নেই। অথচ ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
আলোচনা শেষে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধের দাবিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাম জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ। ওইদিন বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জমায়েত শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক অভিমুখে মিছিল করবে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
ইনিউজ ৭১/এম.আর