ইসলামে তাওবার গুরুত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শনিবার ২৩শে মে ২০২০ ০৮:৫৯ অপরাহ্ন
ইসলামে তাওবার গুরুত্ব

তাওবার শাব্দিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, স্বীকার করা, অনুশোচনা ইত্যাদি।  ইসলামের পরিভাষায় তাওবা হলো গুনাহের মন্দত্বের কারণে তা পরিত্যাগ করা, অতীতে যা হয়েছে সেজন্য অনুশোচনা করা, পুনরায় গুনাহ করার ইচ্ছা পরিহারে দৃঢ় সংকল্প করা এবং যা সম্ভব তা পুনরায় করার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা। [নাদ্রাতুন নাঈম ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৭১] হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মতে তাওবার শর্ত ৬টি।

১. অতীত মন্দকাজের জন্য অনুতাপ করা, ২. যে সকল ফরজ, ওয়াজিব, পরিত্যাগ করা হয়েছে তার কাযা আদায় করা, ৩. কারো ধন সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে থাকলে তা ফিরিয়ে দেয়া, ৪. কাউকে হাত বা মুখ দ্বারা কষ্ট দিলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া, ৫. ভবিষ্যতে সে পাপ কাজ না করার দৃঢ় সংকল্প করা, ৬. নিজেকে যেমন আল্লাহর নাফরমানিতে দেখেছে তেমনি নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য দেখা। উপরিউক্ত বিষয়াবলীর সমাবেশের নামই তাওবা।

ক্বোরআন করিমে তাওবার নির্দেশ তাওবা হচ্ছে, মন্দের ব্যাপারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া। তাওবা বিষয়ে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন- وَاسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوْا اِلَيْهِ اِنَّ رَبِّيْ رحِيْمٌ وَدُوْدٌ-

আর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে এসো। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক পরম দয়ালু ও অতীব ভালোবাসা পোষণকারী

[সূরা হুদ: আয়াত- ৯০] আল্লাহ্ তা‘আলা ঈমানদারদেরকে উভয় জগতের সফলতা অর্জনের জন্য তাওবার নির্দেশ দিয়ে বলেন- হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। [সূরা নূর: আয়াত-৩১] অন্যত্র আল্লাহ্ তা‘আলা খাঁটি তাওবা করার জন্য মুমিনদের নির্দেশ দেন-
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নিকট তাওবা কর, খাটি তাওবা। [সূরা তাহরীম: আয়াত-৮] ক্বোরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত বাক্যসমূহ দ্বারা তাওবা করা সর্বোত্তম।

ক্বোরআন করিমে তাওবার দো‘আসমূহ পবিত্র ক্বোরআনে ব্যবহৃত কিছু দো‘আ নিুরূপ- 

ক. رَبَّنَا ظَلَمْنَا اَنْفُسَنَا وَاِنْ لَمْ تَغْفِرْلَنَا  وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مَنَ الْخَاسِرِيْنَ-

হে আমাদের প্রভু, আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন তবে অবশ্যই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। [সূরা আ’রাফ: আয়াত- ২৪] খ.رَبَّنَا اِنَّنَا اَمَنَّا فَاغْفِرْلَنَا ذُونُوْبَنا وَقِِنَا عَذَابَ النَّارِ- হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা ঈমান এনেছি, কাজেই আমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিন আর আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।

[সূরা আলে ইমরান: আয়াত- ১৬] গ. رَبَّنَا فَاغْفِرْلَنَا ذُنُوْبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّأَتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْاَبْرَارِ- হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিন এবং দোষত্র“টিসমূহ দূর করে দিন। আর আমাদেরকে নেক্কার বান্দাদের সাথে মৃত্যু দিন।

[সূরা আলে ইমরান: আয়াত- ১৯৩] ঘ.اَنْتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْلَنَا وَارْحَمْنَا وَاَنْتَ خَيْرُ الغَافِريْنَ- আপনি আমাদের রক্ষক, সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি করুনা করুন। আর আপনিতো সর্বাধিক ক্ষমাকারী। [সূরা আ‘রাফ: আয়াত- ১৫৫]

হাদীস শরীফে তাওবার দো‘আ হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সয়্যিদুল ইসতিগফার তথা সর্বোত্তম তাওবা হল-

হে আল্লাহ্, আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া আর কোন প্রভু নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দাহ্ এবং যথাসম্ভব আমি আপনার অঙ্গীকার ও ওয়াদার উপর স্থির আছি। আমার সকল পাপের অপকারিতা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আপনার দেয়া সকল নেয়ামতের কথা স্বীকার করছি। আর আমার সকল গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা আপনি ব্যতীত কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।

[সহীহ বুখারী শরীফ: হাদীস নম্বর- ৫৯৪৭] তাওবার ফজিলত হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে মুমিন ব্যক্তি বিছানায় গমনের সময় তুমি নিন্মোক্ত দো‘আ পাঠ করবে, তাহলো- اَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِى لَااِلَهَ اِلَّا هُوَ الْحَىُّ القَيُّوْمُ وَاَتُوْبُ اِلَيْهِ-

অর্থাৎ আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী। আর আমি তাঁর নিকট তাওবা করছি। আল্লাহ্ তা‘আলা তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়, যদিও তা গাছের পাতা সংখ্যক হয়, যদিও তা মরুভূমির বালকুণা সংখ্যক হয়, যদিও তা পৃথিবীর দিবস সংখ্যক পরিমাণ হয়। [তিরমিযী: হাদীস- ৩৩৯০] তাওবার উপকারিতা

১. ইহকালীন কল্যাণ: অফুরন্ত সুখ অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা তাওবাকারীদের ভালবাসেন। তিনি তাওবাকারীদেরকে অফুরন্ত সুখ সম্ভোগ দান করেন। যেমন- মহাগ্রন্থ আল্ ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে- আর যদি তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁরই প্রতি তাওবা কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে অতি উত্তম সামগ্রী উপভোগ করতে দেবেন। [সূরা হুদ: আয়াত- ০৩]

২.প্রচুর ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি লাভঃ এ মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন- হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম তাঁর সম্প্রদায়কে তাওবার নির্দেশ দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন তা ক্বোরআনে বিধৃত হয়েছে এভাবে) ‘‘আর আমি বললাম যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতিতে উন্নতি দান করবেন। আর তোমাদের জন্য উদ্যানগুলো রচনা করবেন ও নহরসমূহ প্রবাহিত করবেন।[সূরা নূহ: আয়াত- ১১-১২] 

৩.পরকালীন মুক্তি: গুনাহকে নেকীতে পরিবর্তন আল্লাহ্ তা‘আলা তাওবাকারীদের অত্যন্ত পছন্দ করেন। তাদের পাপ কর্মকে নেকীতে পরিবর্তন করা হয়। এ মর্মে এরশাদ হলো-

কিন্তু যারা তাওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎ কর্ম করে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের পাপকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করেন। [সুরা ফুরকান: আয়াত- ৭০] 
৪. গুনাহ্ মোচন ও জান্নাত লাভঃ এ মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট খাঁটি তাওবা কর। তাহলে তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত। [সূরা তাহরীম: আয়াত- ৮]

৫. তাওবাকারী নিষ্পাপ হওয়া: এ মর্মে হাদীস শরীফে বর্ণিত, আছে যে- হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তাওবাকারী ঐ ব্যক্তির ন্যায় যার কোন গুনাহ নেই। [সুনানে বায়হাকী শরীফ: হাদীস- ২০৩৫০] 

আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশ অনুযায়ী অতীত গুনাহের কথা স্মরণ করে ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প করার মাধ্যমে তাওবা করা সকলের একান্ত কর্তব্য। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত আমাদেরকে খাঁটি তাওবা করে তাঁর প্রিয়ভাজন হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।

শিল্পী আকতারসহকারী শিক্ষক, সেনানিবাস  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব