করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইসলাম!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শুক্রবার ২২শে মে ২০২০ ০৭:৩৬ অপরাহ্ন
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইসলাম!

বিশ্ব ব্যাপী করোনা ভাইরাস তথা কভিড ১৯ এক ভয়াবহ আতংকের নাম।জাতিসংঘ ইতোমধ্যে কভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষনা করেছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র বিশ্বে এ ভাইরাসে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু বরণ করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও উন্নত চিকিৎসা নির্ভর দেশও এ রোগের প্রতিরোধ করতে অপরাগতা প্রকাশ করেছে।এখনো পর্যন্ত এ রোগ প্রতিরোধ করার মেডিসিন কিংবা ভেকসিন আবিস্কার করতে সক্ষম হয়নি। এমতাবস্থায় করোনা ভাইরাস  প্রতিরোধে ইসলাম কি বলে তথা ইসলামিক বিধি নিষেধ সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসের আলোকপাত সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

ইসলাম যে কোন মহামারিতে আতংকিত না হয়ে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হতে বলা হয়েছে, কেননা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন বিপদই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি বলেন: “আল্লাহ যা আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছাড়া কোনো কিছুই আমাদের স্পর্শ করবে না; তিনিই আমাদের অভিভাবক। আল্লাহর উপরই মুমিনদের নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ।” (সূরা আততাওবা, ৫১)

গুজবে কান না দেয়া ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে  ইসলামে জোর নিষেধ  রয়েছে, ইসলামে যাচাই ছাড়া কোনো তথ্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, “কোনো অসমর্থিত ব্যক্তি কোনো খবর দিলে তোমরা তা যাচাই করো।” (সূরা আল-হুজুরাত: ৬) এ সম্পর্কে মহানবী সা. বলেন, “যাচাই না করে শোনা খবর বিশ্বাস করা মিথ্যুক হওয়ার নামন্তর।” (মুসলিম) 

সঠিকভাবে ও সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সতর্ক হতে বলা হয়েছ,  মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করে। এ কারণে আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো।” (সূরা আননিসা: ৭১) হাদীসে শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা বলেন, “তোমার ওপর তোমার শরীরেরও অধিকার রয়েছে।” (বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৮)যে এলাকায় মহামারি আক্রান্ত হয় সে এলাকার প্রবেশ ও বাহির বন্ধ করে দেয়া। এ সম্পর্কে মহানবী সা. বলেন, “যদি তোমরা শুনতে পাও কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বুখারী, হাদীস নং ৫৩৯৬)

মহামারী রোধে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক রাখাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আইসোলেশন বলা হয়। মহানবী সা. এ সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, অসুস্থকে সুস্থের কাছে নেয়া হবে না। (বুখারী, ৫৭৭১ ও মুসলিম, ২২২১)

সুস্থ ব্যক্তি মহামারীতে আক্রান্তের আশংকায় জনবিচ্ছিন্ন থাকাকে কোয়ারেন্টাইন বলা হয়। বিভিন্ন হাদীসে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন মহানবী সা বলেন, কোনো বান্দা যদি মহামারী আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে, সওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তাকদিরে যা চূড়ান্ত রেখেছেন তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে শহীদের সমান সওয়াব। (বুখারী, ৩৪৭৪ ও মুসনাদে আহমাদ, ২৬১৩৯)

বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসাফাহা ও কোলাকুলি এড়িয়ে চলতে হবে কেননা এর মাধ্যমে সংক্রামণের ভয় থাকে। রাসূলুল্লাহ সা. সাকিফের প্রতিনিধি দলের মধ্যকার কুষ্ঠ রোগীকে হাতে হাতে বাইয়াত না দিয়ে লোক মারফত বলে পাঠান, “তুমি ফিরে যাও। আমি তোমার বাইআত নিয়ে নিয়েছি।” (মুসলিম, ২২৩১)  

কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদেরকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। “আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন।” (সূরা আল-বাকারা, ২২২), হাদীসে পবিত্রতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। শরীয়াতের বিভিন্ন বিধানকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম নির্ধারণ করা হয়েছে।আপদকালীন অবস্থায় মহানবী সা. সাহাবীগণকে বাড়িতে নামায আদায়ের নির্দেশ দেন।

তিনি মুআজ্জিনকে আজানের মধ্যে বলতে বলেন, “আলা সাল্লু ফী রিহালিকুম” (তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে নামায আদায় কর)। (বুখারী ৬৬৬, মুসলিম ৬৯৭) তাঁর ইন্তিকালের পরে সাহাবীগণও একইভাবে আমল করতেন। সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে এর প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মুআজ্জিনকে নির্দেশ দেন আজানে “সাল্লু ফী বুয়ূতিকুম” (তোমরা বাড়িতে সালাত আদায় কর) অংশটি যোগ করার জন্য। (বুখারী ৬৬৮, মুসলিম ৬৯৯) ইসলামী শরীআর উদ্দেশ্য ও মহামারীর গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় মিসর, সৌদীআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফিকহ কমিটি ও ইসলামী ফাউন্ডেশন মসজিদে মুসল্লীদের উপস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সকলকে ঘরে ইবাদাত করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনের এ দিনগুলোতে গরীব-অসহায় ও নিম্নআয়ের মানুষের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা বৃত্তবানদের ওপর আবশ্যক। এ মহৎ গুণের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, “খাদ্য দান করা দুর্ভিক্ষের দিনে। ইয়াতীম আত্মীয়-স্বজনকে। অথবা নিঃস্ব মিসকীনকে।” (সূরা আল-বালাদ)

সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে, ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম সরকার জনকল্যাণ বিবেচনায় কোন নির্দেশনা দিলে এবং তা শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক না হলে তা মান্য করা অপরিহার্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূলের ও তোমাদের নেতৃস্থানীয়দের।” (সূরা আন-নিসা, ৫৯)

এ কঠিন বিপদের সময় বেশি বেশি  তওবা-ইস্তেগফার করা, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, কোরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদত, তাহাজ্জুদ নামাজ,নফল রোজা আদায় করা, বেশি বেশি দুরুদ শরীফ পাঠ করা, সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এ কঠিন মসিবত থেকে তিনি যাতে আমাদের সমগ্র বিশ্বের মানুষকে হেফাজত করেন। আমিন।

মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক সুমন, সহকারি অধ্যাপক শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট 

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব