খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টি নিয়ে ইসলাম যা বলে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২৪শে মার্চ ২০২০ ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টি নিয়ে ইসলাম যা বলে

বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী মহামারি করোনায় আতঙ্কিত হয়ে থমকে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে বিশ্বের অনেক জনবহুল দেশ ও শহরের মানুষ। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে।করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করবে এ খবরে দেশের ব্যবসায়ীরা যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার বিত্তশালী সাবলম্বীদের চাহিদার তুলনায় বেশি কেনাকাটায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা অন্যদিকে একশ্রেণির মানুষ অভাবের তাড়নায় স্ত্রী-সন্তানদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারছে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তশালীর খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই  বিশ্ব অর্থনীতি এখন চরম হুমকির সম্মুখীন। জিনিস-পত্রের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়া এবং বিত্তশালীদের চাহিদার তুলনায় বেশি জিনিস ক্রয় করায় দেখা দিয়েছে চরম প্রয়োজনিয় জিনিস-পত্রের সংকট। দিন দিন এ সংকট বেড়ে চলেছে।

দেশের অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। যারা দৈনিক রুজির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র মজুদ অব্যাহত থাকলে করোনাভাইরাসের আক্রমণ ছাড়াও মানুষের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিসহ। অথচ ইসলাম এ অবস্থাকে মোটেই সমর্থন করে না। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জগৎবাসীর (মানুষের) প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি)কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মানুষ পরস্পরের প্রতি সদয় না হয়ে একে অপরকে কঠিন বিপদের দিতে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেছে মানুষ। নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কিছুই মেনে নিতে পারছে না। বাজারের বর্তমান কেনাকাটার পরিস্থিতি তাই প্রমাণ করছে।

করোনা থেকে বাঁচতে কী পরিমাণ চাল-ডাল-আলু-ডিমসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দরকার ভোক্তাদের? আবার এসব নিত্য পণ্যসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কী পরিমাণ বাড়ালে খুশি হবে ব্যবসায়ীরা? কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর?অথচ বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হোক আর যেভাবেই হোক ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তশালী কেউ যেন খাদ্য মজুদ না করে সে ব্যাপারে কঠিন সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে, আল্লাহ তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহ তাআলার জিম্মাদারি থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নায়ে ইবনে আবি শায়বা) করোনা বা মহামারিতে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, মানুষ তো আশরাফুল মাখলুকাত। তার সব কাজ হবে কল্যাণের। আর এ জন্যই তো তাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-

‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দান করবে এবং মন্দকাজে বাধা দেবে।’ (আল-ইমরান : আয়াত ১১০) করোনাভাইরাসের কারণে খাদ্য গুদামজাত কিংবা বেশি খাদ্য মজুদ করে যেমন কাউকে কষ্ট দেয়া যাবে না তেমনি করোনা আসছে আসছে বলে কাউকে আতঙ্কিতও করা যাবে না। কেননা আতঙ্ক সৃষ্টি করাও মুমিনের কাজ নয়।মানুষ কতটা বিবেক বিবর্জিত হয়ে গেছে যে, প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাস নিয়েও মানুষ ব্যবসার চিন্তা-ফিকির করছে। মানুষকে জিন্মি বা হয়রানি করে কিংবা আতঙ্ক ছড়িয়ে অর্থ উপার্জন বা ফায়েদা লোটার চিন্তা-ভাবনা করছে। এটি কল্যাণকামী কোনো মানুষর কাজ হতে পারে না।

আতঙ্ক সৃষ্টিতে যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নেই আবার তাতে ব্যক্তি নিজের ও পরিবারেরও কোনো কল্যাণ নেই। সুতরাং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ যে কোনো মাধ্যমে যে কোনো কথা বা গুজব শুনে তার সত্যতা না জেনে ছড়িয়ে দেয়াও অনেক বড় গোনাহের কাজ। হাদিসে এসেছে-যা শুনে তা বলে বেড়ানো কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (আবু দাউদ)

এ হাদিসের আলোকে সমাজে ছড়ানো আতঙ্ক বা গুজব যদি মিথ্যা হয়। তবে এ অপরাধের অপরাধী মুনাফিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কেননা মুনাফিকের আলামতের মধ্যে মিথ্যাও একটি। সে আলোকে অযথা আতঙ্ক বা গুজব ছড়ানো মুমিনের কাজ নয় বরং তা মুনাফেকি। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে।’ (বুখারি)

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাকে কেন্দ্র করে নানান গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘কেয়ামত খুব সন্নিকটে’, ‘২০২০ সালেই ইমাম মাহদি চলে আসছেন’, ‘দাজ্জালের জন্ম হয়েছে, দাজ্জালকে আকাশে দেখা গেছে কিংবা দাজ্জাল এসে পড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি গুজব।আবার করোনায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকে দাফন নয় আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে কিংবা হাসপাতালে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে আর সরকার তা প্রকাশ না করে গোপন করছে কিংবা লাশ গুম করে ফেলছে ইত্যাদি আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অথচ এসবই গুজব। আর তা যাচাই-বাছাই না করে তা প্রচার করাও চরম মিথ্যাচার।

সুতরাং যারা এসব কথা শুনেই তা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, তারা হয়ে যাচ্ছে মিথ্যাবাদী আবার সামাজিকভাবে তারা যেমন হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। এরকম ভিত্তিহীন গুজব প্রচারে রয়েছে রাষ্ট্রীয় শাস্তি অন্য দিকে এ অপরাধে পরকালেও রয়েছে মারাত্মক শাস্তির বিধান। এভাবে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ৬)

- ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৩৬)

মনে রাখতে হবে

ফ্রিজ ভর্তি খাদ্য মানুষকে কোনো মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারেনি আর পারবেও না। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে পরীক্ষা করবেন বলে কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন-আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫)করোনায় ফ্রিজ ভর্তি খাদ্য মজুদ নয় বরং হাদিসের ঘোষণায় সাদকার দ্বারা বিপদ দূর হয়, হায়াতে বরকত হয়। কেননা দুনিয়ার শান্তি এবং আখেরাতের পাথেয়ও হচ্ছে সাদকা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তশালীদের খাদ্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। গরিব-অসহায় ও নিম্নবিত্তদের দান-সাদকা করে সম্পদ ও হায়াতে বরকত লাভের তাওফিক দান করুন। গুজব ছড়ানোর মতো হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। কুরআন-বিধানগুলো যথাযথ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ইনিউজ ৭১/ জি.হা