মুসলমান ও ইহুদিদের চিরন্তন লড়াইয়ের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রের কাহিনী ও ইতিহাস

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডাক্তার আরিফুর রহমান, বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক
প্রকাশিত: সোমবার ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:০২ অপরাহ্ন
মুসলমান ও ইহুদিদের চিরন্তন লড়াইয়ের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রের কাহিনী ও ইতিহাস

হজরত আলী (রা) খাইবারের যুদ্ধে ইহুদীদের দুর্গের দরজা ভেঙ্গে তার ঢাল বানিয়েছিলেন, পরে নাকি ৪০ জন মানুষ ধরাধরি করে সেই দরজা মাটি থেকে উঠিয়েছিলো। ষাটের দশকে বরিশাল জিলা স্কুলে কোন ক্লাশে যেন আমাদের পাঠ্য বইতে পড়া এই কাহিনীটি মনের মধ্যে গেথে ছিলো বহুদিন। ১৯৭৭ সনে সৌদি আরবে আসার পর অনেক সৌদিকে জিগ্যেস করেছি খাইবার কেল্লা কোথায় বলতে পারো? 

দাম্মাম, রিয়াদের কেউ কোনো খবর দিতে পারেনি। ১৪০০ বছর আগের যুদ্ধ সম্মন্ধে জানতে চাইলে দেখলাম তারা আমার চাইতেও কম জানে। ১৯৭৯ সনে রিয়াদের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের একটা অফিস তখন সমীচী এলাকাতে ছিল, খুঁজে পেতে অনেকক্ষণ  লাগলো, কিনতু লাভ হলোনা। 

"ওয়াল্লাহে মানাদ্রী, এস আল খায়বার, ওয়েন হারব? মা এন্দেনা হারব তাউ,"  আমার প্রশ্নের জবাবে খুব সন্দেহের নজর দিয়ে অফিসারটি যা বললেন তার অর্থ হলো, "আল্লার কসম আমি জানিনা, খাইবার কি, কোথায় যুদ্ধ ? ইদানিং কোথাও যুদ্ধ হয়নি।"  পুলিশ না ডেকে বসে তাই ভয়ে ভেগে এলাম। খাইবারের দুর্গ কোথায় সে প্রশ্ন আমার মাথায় রয়ে গেলো। 

নবী করিম (স) আল্লাহর হুকুমে মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করে আসার পরও কুরাইশদের অত্যচার আর ষড়যন্ত্র থেমে রইলনা। মদিনার তত্কালীন ধনী ইহুদী সম্প্রদায় একই দেশে থেকে, মুসলমানদের প্রতিবেশী হয়েও তাদের বিরুদ্ধে বাইরের শত্রুদের সহায়তা শুরু করলো গোপনে। এই ধরনের অত্যাচার যখন মুসলমানদের ওপর চলছিলো তখন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আয়াত নাজেল করলেন। 

"যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায় ভাবে বের করা হয়েছে শুধু এজন্যে যে তারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে আর এক দল দিয়ে বাধা না দিতেন তা হলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত (খ্রিস্টানদের) মঠ ও গির্জা, ধ্বংস হয়ে যেতো (ইহুদিদের) ভজনালয়, আর মসজিদ --যেখানে আল্লাহর নাম বেশি করে স্মরণ করা হয়; আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেন যে তার (ধর্মকে) সাহায্য করে। আল্লাহ নিশ্চয়ই শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সুরা হজ,আয়াত ৩৯-৪০)। 

আল্লাহর এই হুকুমের পর মুসলমানরা তলোয়ার উঠালো হাতে, কোনো দেশ দখলের জন্যে নয়, কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যে নয়, কোনো রাজনীতি বা মানুষ রচিত কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়, শুধু "আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ" এই কথার ওপর বিশ্বাস পৃথিবীর বুকে প্রোথিত করার জন্যে। শুরু হলো প্রথম লড়াই, বদরের প্রান্তরে।

প্রায় খালি হাতে, খালি পায়ে ৩১৩ জন মুসলমান, অভুক্ত রোজা রাখা, অন্য দিকে ১০০০ ট্রেইনড কোরাইশ অস্রধারী সৈন্য। আল্লাহ বললেন, "আর বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন, তখন তোমরা  ছিলে হীনবল। (সুরা আল ইমরান ১২৩)।  আমি তোমাকে সাহায্য করবো এক সহস্র ফেরেস্তা দিয়ে যারা একের পর এক আসবে (সুরা আনফাল ৯)।  

মুসলমানদের অভাবনীয় বিজয় দিলেন আল্লাহ। কিন্তু যারা অদৃশ্যে বিশ্বাসী হয়না, কোনো উদাহরণ, কোনো যুক্তি তাদের মনকে পরিবর্তন করাতে পারেনা। তাই কোরাইশদের আক্রমন আর ইহুদিদের  গোপন ষড়যন্ত্র থেমে রইলোনা। একের পর এক যুদ্ধ চলতে লাগলো ওহুদের, খন্দকের বড় বড় যুদ্ধ ছাড়াও ছোট খাট যুদ্ধ প্রায়ই করতে হতো মুসলমানদের।  

ইহুদিদের সমস্যা ছিল দুটি, একটা হচ্ছে তাদের বানিজ্যিক আধিপত্য, আর একটা ঈর্ষা, ---আরবদের থেকে কেন শেষ নবী হলো? 

খন্দকের যুদ্ধে ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজার জাতীয় ভাবে বেইমানির পর তাদের যুদ্ধ অপরাধের বিচার চাইলো মুসলমান শাসকরা। বনু কোরাইজা গোত্র থেকেই নির্ধারিত হলো ইহুদি বিচারক। তিনি নিজ গোত্রের প্রায় ৬০০ যুদ্ধপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেবার পর বাকি ইহুদিরা মদিনা থেকে মাইগ্রেট করে ৯৩ মাইল দুরে খায়বার মরুদ্যানে চলে যায়। প্রচুর পানি, উর্বরা মাটি, তাদের টেকনোলজি আর প্রচুর অর্থ খরচ করে বর্তমান ইসরাইলের মতো শক্তিশালী ছোট খাট একটা রাষ্ট্র বানালো তারা খাইবারে। ওদের অনেকগুলি স্টিল ইন্ডাস্ট্রী ছিল যেখানে আধুনিক অস্র তৈরী হতো। 

মক্কার কুরাইশদের সাথে হোদায়বিয়ার অসম চুক্তি করার ফলে ইহুদিরা ধরে নিল, মুসলমানরা দুর্বল। তাই তারা সন্ত্রাসী অর্থায়ন করা শুরু করলো মদিনা আর খাইবারের মাঝখানে বেদুইন গোত্র গাত্ফানকে, যাতে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালায়। গাত্ফানরা প্রায়ই ঝামেলা করতো মুসলমানদের ওপর আক্রমন করে।

একবার উট চরানো অবস্থায় হজরত আবু জর গিফারী (রা)র ছেলে আর তার মাকে ধরে নিয়ে গেলো ওরা, ছেলেটাকে হত্যা করে গিফারী (রা) এর বিবি আর উট নিয়ে ওরা যখন ভেগে যাচ্ছিল তখন মুসলমানদের একটি টহলদারী পেট্রল তাদেরকে আটক করে এবং রিম্যান্ড জাতীয় অবস্থায় আটককৃত দুর্বৃত্তরা খাইবারের ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের কথা বলে দেয়। 

এই ঘটনার পরে আল্লাহর নবী (স) আল্লাহর হুকুমে খাইবার আক্রমনের পরিকল্পনা করেন।  মাত্র ১৪০০ থেকে ১৮০০ মুসলিম সেনা, সাথে ১০০ বা ২০০ ঘোড়া  নিয়ে খাইবার অভিমুখে তিন দিনের যাত্রা শুরু হলো, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ মে মাস, ৭ই মহররম। খাইবারে তখন ১০,০০০ ইহুদি সৈন্য তাদের সুরক্ষিত দুর্গে; তাদের কাছে নিজেদের তৈরী করা অত্যাধুনিক অস্রসস্র। মুসলমানদের অভিযানের খবর পেয়ে ইতিমধ্যে গাত্ফান্ গোত্রের ৪ হাজার সৈন্য ইহুদিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে খাইবারের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু আলরাজি  উপতক্যা মুসলমানরা দখল করেছে শুনে গাত্ফানরা নিজের এলাকায় ফিরে যায়। বলা হয়, তখন গাত্ফানদের কাফেলা আকাশ থেকে বার বার উচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ শোনে, --তাদের বিপদ হবে যদি তারা খাইবার যায়, তাই নাকি তারা ফিরে আসে।

খাইবারে ইহুদিদের ৮ টি দুর্গ ছিল।  মুসলমানদের অতর্কিত আক্রমনে নাতাত আর শিক্ক এলাকার সব দুর্গ পতন হয়, বাকি রয়ে যায় সুরক্ষিত আল কামুস দুর্গ। 

মুসলমানদের অবরোধের মধ্যেও ইহুদিরা  রাতের আধারে কামুস দুর্গে একত্রিত হয়। খাড়া পাহাড়ের ওপর এই দুর্গে হজরত আবু বকর প্রথমে, পরে হজরত ওমর (রা) ব্যার্থ আক্রমন চালান। তখন একদিন নবী (স) বললেন কাল প্রত্যুষে একজনকে আক্রমনে পাঠানো হবে যিনি আল্লাহ ও রসুলের প্রিয় এবং আল্লাহ ও  রসুল তার প্রিয়; তিনিই কেল্লা ফতেহ করবেন ইনশাল্লাহ।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব