ফুটবলেরই আরেক নাম ম্যারাডোনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৬শে নভেম্বর ২০২০ ১২:৩৭ পূর্বাহ্ন
ফুটবলেরই আরেক নাম ম্যারাডোনা

দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা। ফুটবলেরই আরেক নাম। অনেকে ফুটবল বিশেষজ্ঞ, সমালোচক, সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবেই গণ্য করেন। ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ে তার পাশে ছিলেন কেবলই ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি পেলে।দুবার ট্রান্সফার ফির বিশ্বরেকর্ড গড়া একমাত্র ফুটবলার ম্যারাডোনা। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে যাওয়ার সময় ৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইউরো।নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন এ কিংবদন্তি। 

আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৩৪টি গোল করেছেন ম্যারাডোনা। চারটি বিশ্বকাপ খেলা এ ফুটবলার দেশটি একক নৈপুণ্যে বিশ্বসেরার ট্রফি জিতিয়েছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার অবদান শুধু আর্জেন্টিনাতেই নয়, বিশ্ব ফুটবলে রাজার আসনে আসীন করেছে তাকে।বলা যায়, এই ম্যারাডোনাই দুনিয়াজুড়ে আকাশি-সাদা জার্সির লাখো কোটি ভক্ত সমর্থক তৈরি করে গেছেন।১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা। দুটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অব গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি ম্যারাডোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফাডটকমের ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করেন।

ম্যারাডোনার জন্ম ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরে, খুবই গরীব পরিবারে। তিনি বেড়ে ওঠেন ভিয়া ফিওরিতোতে, যা বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ প্রান্তের একটি শান্তিটাউন।বাবা-মায়ের তিনটি কন্যা সন্তানের পর তিনিই ছিলেন ছেলে। তার ছোট দুই ভাই রয়েছে হুগো (এল তুর্কো) এবং রাউল (লালো)। তারাও পেশাদার ফুটবলার ছিলেন।১০ বছর বয়সে যখন এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলছিলেন তখন দিয়েগোকে খুঁজে বের করেন একজন স্কাউট। এরপর তিনি দ্য লিটল অনিঅনের (আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল) একজন মূল খেলোয়াড়ে পরিণত হন।আর্জেন্টিনার প্রথম বিভাগের খেলায় বল-বয় ছিলেন ম্যারাডোনা। তখন তার বয়স ১২ বছর। তখন খেলার অর্ধ বিরতির সময় বল নিয়ে জাদুকরি কারুকার্য দেখিয়ে তিনি দর্শকদের সন্তুষ্ট করতেন।

১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, নিজের ষোলতম জন্মদিনের দশ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। ১৬৭ ম্যাচে গোল করেন ১১৫টি। এরপর ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি জমান। ১৯৮১ মৌসুমের মাঝামাঝি সময় বোকায় যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন।

ইউরোপে ম্যারাডোনা

১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ৫ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফিতে বার্সেলোনায় যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেটিক বিলবাওকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতে। তবে, বার্সায় ম্যারাডোনা কিছুটা খারাপ সময় কাটিয়েছেন। প্রথমে তাকে হেপাটাইটিসের সাথে লড়তে হয়। এরপর গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন। অবশ্য, চিকিত্‍সা শেষে দ্রুতই মাঠে ফেরেন। বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন।
বার্সেলোনায় থাকাকালে ক্লাব পরিচালকদের সাথে দফায় দফায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ম্যারাডোনা; বিশেষ করে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ইয়োসেপ লুইস নুনেজের সাথে। ১৯৮৪ সালে আরেকটি রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে (৬.৯ মিলিয়ন ইউরো) সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি।

তার যাদুর ছোয়ায় অখ্যাত নাপোলিকে চেনে সারা দুনিয়া

১৯৮৫ সালে নাপোলির হয়ে মাঠে নামেন। এই ক্লাবেই ম্যারাডোনা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শিখরে পৌঁছান। খুব দ্রুত ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার যাদুতে নাপোলিও নাপোলিও তার ইতিহাসের সেরা সময় কাটায় তখন। ম্যারাডোনার অধীনে ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানারআপ হয়। তার সময়ে নাপোলি একবার কোপা ইতালিয়া (১৯৮৭) জেতে এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয়। ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপও জেতে নাপোলি। ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।

ইতালিতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যায় জড়ায় ম্যারাডোনা। তার কোকেইন নেশা বহাল থাকে। অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকায় ক্লাবের পক্ষ হতে তাকে ৭০,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। ইতালিতে তাকে পুত্রসন্তান সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হতে হয়। এরপর ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন।তবে ম্যারাডোনা নাপোলির কাছে আজও সম্মানিত। নাপোলিতে তার অর্জনসমূহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ক্লাবের ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ এবং ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই ম্যারাডোনাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী হলেও স্পেনের ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে দুই বছর খেলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কিছু আগে ম্যারাডোনা টটেনহাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টারন্যাজিওনালের বিপক্ষে। খেলায় টটেনহাম ২–১ গোলে জয় লাভ করে। তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি ম্যারাডোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি ১৯৯০ বিশ্বকাপে রানার আপ করেন ম্যারাডোনা।

১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতার ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ১৯৭৯ সালের ২ জুন স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করেন মারাদোনা। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ফিফা অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ (১৯৭৯) ও ফিফা বিশ্বকাপ (১৯৮৬) উভয় প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বল জিতেছেন।

চারটি বিশ্বকাপে (১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ এবং ১৯৯৪) আর্জেন্টিনার হয়ে টানা ২১টি খেলায় মাঠে নামেন মারাদোনা।১৬টি খেলায় জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছেন, যা একটি বিশ্বকাপ-রেকর্ড। বিশ্বকাপের ২১টি খেলায় ৮টি গোল করেন এবং অন্য ৮টি গোলে সহায়তা করেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে করেন ৫টি গোল এবং ৫টি সহায়তা।