পাপিয়া সম্পর্কে তথ্য দিবে না ওয়েস্টিন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:২৫ অপরাহ্ন
পাপিয়া সম্পর্কে তথ্য দিবে না ওয়েস্টিন

শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ যেই হোটেলে মাসের পর মাস অবস্থান করে নানা অপকীর্তি চালিয়েছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য, তার সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে রাজি হচ্ছে না হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, হোটেলের অতিথির তৎপরতার বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা ‘নিয়ম পরিপন্থি’। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোটেলে বসে কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালালে তার দায় হোটেল কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।

গত শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া ও তার স্বামীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে ওয়েস্টিন হোটেলে তার কক্ষ ও ঢাকার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মদ, পিস্তল, অর্থ, বিদেশি মুদ্রা পাওয়ার কথাও র‌্যাব জানায়। গ্রেপ্তারের পর পাপিয়াকে বহিষ্কার করে যুব মহিলা লীগ।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটির টাকার উপরে।

পাপিয়াকিাণ্ডে আলোচনায় উঠে আসা পাঁচ তারকা ওয়েস্টিন হোটেলে সোমবার দুপুরে গিয়ে দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইলে হোটেলের মার্কেটিং কমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক সাদমান সালাহউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন অভ্যর্থনায় থাকা কর্মীরা। পরে ওয়েস্টিন হোটেলের লবিতে সঙ্গে প্রায় ২০ মিনিট ধরে কথা বলেন সাদমান। তবে পাপিয়ার হোটেলবাস সম্পর্কে কিছুই জানাতে রাজি হননি তিনি।

সাদমান বলেন, “উনি আমাদের স্যুইট নিয়েছিলেন। এটা বিশাল আকারের তো, উনার গেস্টরা সেখানে ছিলেন। তিনি কাদেরকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করেছেন কিংবা কতজন ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাবলিকলি প্রকাশ করা হোটেলের নিয়ম পরিপন্থি।”

২৩ তলা বিশিষ্ট ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যারিয়ট বনভয়‘র চেইনভুক্ত। ওই হোটেলের লেভেল-২২ এ ১ হাজার ৪১১ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইট।

র‌্যাব জানায়, পাপিয়া ওই হোটেলের প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইটে গত ১২ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ২০ দিন ছিলেন। গত ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই হোটেলে অবস্থান করছিলেন। বিমানবন্দরে যখন গ্রেপ্তার হন, তখনও তার নামে ওই স্যুইট ভাড়া করা ছিল।

দ্বিতীয় দফায় স্যুইটের ভাড়া বাবদ পাপিয়া ৮১ লাখ ৮২ হাজার টাকা পরিশোধ করেন বলেও তার বিরুদ্ধে করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই খরচের উৎস অবৈধ বলে র‌্যাবের ধারণা।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, “তাদের আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটির টাকার উপরে। ”

হোটেলের বিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাদমান বলেন, ব্যবসার নিয়ম অনুযায়ী হোটেল কর্তৃপক্ষ একেকজন গেস্টের কাছ থেকে একেক ধরনের চার্জ নিয়ে থাকে।

“সেটা একটি মিউচুয়াল আন্ডারস্টান্ডিং ও হোটেলের চলমান প্যাকেজের বিষয়। এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”

সাদমান বলেন, হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে অতিথি কী কী কাজ করেন, তা দেখার সুযোগ নেই।

“এ ধরনের ঘটনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে। কিন্তু এ ঘটনায় হোটেল দায়ী হতে পারে না। আমাদের গেস্ট এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। রুমে যারা আছে, তাদের প্রাইভেসি আছে। এখন কে কোথায় কী করেছে, সেটা দেখার সুযোগ নেই। আমাদের রুমের মধ্যে কোনো ক্যামেরা নেই। ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি না।”

পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “এই নারীর নামে ওই হোটেলের ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ সব সময় বরাদ্দ থাকত। নিজের এবং কাস্টমারদের মদ-বিয়ার পান করানো বাবদ হোটেলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতেন তিনি। এই হোটেলে নিয়মিত কয়েকজন তরুণী থাকত, যারা তার ‘কাস্টমারদের’ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। এজন্য তাদের মাসিক বেতন বরাদ্দ ছিল।”

র‌্যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত জামিল ফাহিম বলেছেন, পাপিয়াকে নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব পেলে তারা হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করবেন।

বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতারা হোটেলে তার কাছে আসত বলে র‌্যাব তথ্য পেয়েছে। অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি ও ভিডিও এখন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল। এমন এক ভিডিওতে ওয়েস্টিনের মালিকপক্ষের একজনকে পাপিয়াসহ বেশ কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে।

পাপিয়া হোটেল কর্তৃপক্ষের আত্মীয় কিংবা পরিচিত কি না- জানতে চাইলে সাদমান বলেন, “যারাই এই হোটেলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করেন এদের অনেকের সাথে আমাদের কর্তৃপক্ষের দেখা হয়। তারা অনেক সময় এক সাথে বসে গল্প করেও থাকতে পারেন। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

যেই প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইটে পাপিয়া অবস্থান করছিলেন- সেখানে ব্যাপক মানুষের আনাগোনা ছিল কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “যারা এখানে ভাড়া নেন তাদের ব্যক্তিগত তৎপরতায় নজর রাখা সম্ভব না। আমরা দেখতেও যাই না। কারা কারা সেখানে এসেছেন, তাদের পরিচয় প্রকাশ করাও সম্ভব নয়।”

সেদিকে যেতে চাইলে সাদমান বলেন, “প্রেসিডেন্ট স্যুট এখন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ওটা গেস্ট রুম। গেস্ট ফ্লোরে আমরা গেস্ট ছাড়া আর কাউকে অ্যালাউ করতে পারি না।” এই বিষয়ে হোটেলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ চাইলে সাদমান বলেন, “উনারা এখন একটি জরুরি মিটিং অংশ নিতে বাইরে বের হওয়ার প্রস্তুত নিচ্ছেন। তাই এই মুহূর্তে কথা বলতে পারবেন না।” ওয়েস্টিন হোটেলকে ঢাকার সবচেয়ে জমজমাট হোটেল দাবি করে তিনি বলেন, “আজকেও হোটেলের ৯১ শতাংশ কক্ষ বুক করা আছে। গতকাল ছিল ৭০ শতাংশ।”

এদিকে ওয়েস্টিন হোটেল নিয়মের অজুহাত তুলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদ। তিনি বলেন, “হোটেলের দায়বদ্ধতা হল, তাদের কাছে (হোটেলের অতিথি) কে আসবে না আসবে সেগুলো ‘স্ট্রিক্টলি মনিটর’ করবে।

“যার নামে হোটেল রুম ভাড়া হয়েছে, তিনি ছাড়া আর কে কে রাতে থাকে, অতিথি ছাড়া রাতে আর কে হোটেলে থাকে, বোর্ডার ছাড়া তো রাতে হোটেলে আর কারও থাকার কথা না। এ ব্যাপারে তারা দায় এড়াতে পারে না। বাইরের মানুষ এসেছে, বাইরের মানুষে থেকেছে উইদাউট দেয়ার কনফার্মেশন, এটা অসম্ভব ব্যাপার।”
ইনিউজ ৭১/এম.আর