পদ্মা সেতুর সুফল পাবেন কৃষক : দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিবিপ্লবের হাতছানি

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: সোমবার ৪ঠা জুলাই ২০২২ ০৮:৫৩ অপরাহ্ন
পদ্মা সেতুর সুফল পাবেন কৃষক : দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিবিপ্লবের হাতছানি

বরিশালকে এক সময় বলা হতো বাংলার শস্যভাণ্ডার। মাটির উর্বরতা আর অনুকূল পরিবেশের কারণে দেশ-বিদেশে এ অঞ্চলের শস্যের কদর ছিল ব্যাপক। দিনে দিনে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে বরিশালের কৃষকরা। ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কৃষি বিশ্লেষকরা। ঐতিহ্য হারানোর সেই গøানি এবার মুছে ফেলার সুযোগ এনে দিয়েছে পদ্মা সেতু। যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া কৃষির সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধার হবে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।


সূত্র মতে, বরিশাল বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চালের উৎপাদন হয় ২৭ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ টন। যা পূর্বের বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ লাখ টন বেশি। শুধু চাল নয়, প্রতি বছর শস্যেরও বাম্পার ফলন হতো। তবে তা হাতেগোনা কয়েকটি শস্যের উৎপাদনে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বড় কারণ চাষিদের অনাগ্রহ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, কোনো শস্য চাষের আগ্রহ হারানোর মূল কারণ কৃষকের সঠিক বাজার না পাওয়া।


এ ব্যাপারে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান নাহিদা সুলতানা বলেন, দেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতু। এতে পূর্বে যেখানে পণ্য পরিবহনে ৭ থেকে ১৫ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগত এখন অতটা সময় খরচ হবে না। আশা করা হচ্ছে সর্বোচ্চ চার ঘণ্টার মধ্যে কৃষিজাত পণ্য ঢাকায় পৌঁছাবে। চার ঘণ্টায় একটি সবজি বা শস্যে পচন শুরু হয় না। যে কারণে স্বল্প সময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছাবে পণ্য। কৃষক লোকসানের মুখে পড়বে না। তাছাড়া কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি খাতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসবে এবং বাংলার শস্যভাণ্ডার বরিশাল তার সমৃদ্ধি ফিরে পাবে।


এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশালের উপপরিচালক হারুন উর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে যে সম্প্রসারণ সৃষ্টি হবে তা অভাবনীয়। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন, কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। আগে ক্রেতা সংকটে যেসব শস্য উৎপাদন হতো না অথচ বাজারে উচ্চমূল্যে তার চাহিদা ছিল, সেগুলো আবাদ হবে। কৃষকের রক্ত চুষে কেউ খেতে পারবে না কারণ দালাল, ফড়িয়া, বেপারিদের এখন আর প্রয়োজন হবে না। কৃষক তার ক্ষেত থেকে শস্য উত্তোলন করে সরাসরি ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। সেখানে তিনি তাজা শস্য সরবারহ করে ভালো দাম পাবেন। ওই কৃষক ভোরে ঢাকায় গিয়ে তার পণ্য বিক্রি করে আবার রাতে এসে বাড়িতে ঘুমাতে পারবেন।


কৃষিবিদ আনোয়ার হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর। এখানে সব ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এই অঞ্চলের তরমুজ, পেয়ারা, আমড়া, মালটা, সবজি বিক্রির জন্য কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। পচনের ভয়ে তরমুজ এখন আর অল্প দামে বেচতে হবে না। দিনে ক্ষেত থেকে যা তুলবেন তা নিয়ে কৃষক সরাসরি দেশের বড় বড় বাজারে চলে যেতে পারবেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিবিপ্লব সূচিত হবে।


বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়েদুল আলম বলেন, উচ্চমূল্যের শস্য যেমন তরমুজ নিয়ে শঙ্কা কেটে গেল চাষিদের। তাছাড়া শুধু বরগুনায় নয়, দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও অনাবাদি জমি থাকবে না। আগে আমাদের ফসলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও অনেকগুলো পূরণ হতো না। এখন সেই সুযোগ নেই। সেতু চালু হওয়ার আগেই ড্রাগনের বাগান হয়েছে এই অঞ্চলে। উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের সমস্যা ছিল ফেরিঘাটে শস্য পচে যেত। এখন ফেরিও নেই। দক্ষিণাঞ্চল তার শস্যভাণ্ডার ফিরে পেতে কোনো বাধা রইল না।


বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ দেশের সব প্রান্তের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো। পদ্মা সেতুর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হবে। এই অঞ্চলের জনগণ পরিকল্পিত জনসম্পদে রূপান্তরিত হবে। কর্মসংস্থান ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। যা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নতির দিকে ধাবিত করবে। আগামীতে দক্ষিণাঞ্চল হবে অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিল্পনগরী।